বলাৎকার ও ধর্ষণ : শিক্ষাগুরুর নৈতিক স্খলন

পলাশ রায় |

শিক্ষক পরম গুরু। ছাত্র-ছাত্রীর কাছে তিনি দ্বিতীয় জন্মদাতা হিসেবে সম্মানিত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু শিক্ষক নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের হাতে এখন কলঙ্কিত হচ্ছে সে পবিত্র সম্পর্ক। অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়, সে শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রদের বলাৎকার এবং ছাত্রীধর্ষণ’ গণমাধ্যমের অন্যতম শিরোনাম হয়ে উঠেছে এখন। 

গত কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে চরম নীতিহীনতার এ অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।  মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার্থীদেরও বলাৎকারের খবর শোনা যায় এখন। ফাঁদে ফেলে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ  বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও। এমনকী নারী সহককর্মীর সঙ্গে অশালীন আচরণ ও তাদের কুপ্রস্তাব দেয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের প্রশাসনিকভাবে দণ্ডিত হওয়ার বেশকটি ঘটনা ঘটেছে। 

সর্বশেষ মাদারীপুরের শিবচরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ছাত্রী ধর্ষণের। এ ঘটনায় থানায় মামলায়ও হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রথমে ওই শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। আর তার ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলের আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর ছাত্রী ধর্ষণ করতে থাকে। শিবচরের ওই স্কুলের এক ছাত্রীকে এভাবে সপ্তম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগে এখন শিক্ষক রবিউল পলাতক। কেবল ওই ছাত্রীটিই নয়, শিক্ষক রবিউলের বিরুদ্ধে ওই প্রতিষ্ঠানের আরো কয়েকজন ছাত্রীর এমন অভিযোগ এখন পুলিশের কাছে। 

সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রী ও শিক্ষিকা লিখিত অভিযোগ করেছেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সত্যতা মিললেও কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ। কিন্তু এসব ঘটনা কেন ঘটছে, কী এর প্রতিকার- তা নিয়ে এখন নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সময় এসে গেছে।

আমাদের দেশে পেশাজীবীদের নিয়োগদানের সময় মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া হয় না। একজন পুলিশ সদস্য, চিকিৎসক, আইনজীবী, বিচারক কিংবা সাংবাদিকও জানেন না তিনি পেশাগত জীবনে আসলে কে? অবশ্য তাকে নিজের অবস্থান জানাতে রাষ্ট্রেরও কোন বিশেষ উদ্যোগ চেখে পড়ে না। অন্য পেশাজীবীদের কথা  নাই বা বললাম। শিক্ষকদের নিয়ে লেখাই আজকের প্রধান উদ্দেশ্য। আজকের দিনের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের মর্যাদা অর্থের মাপকাঠিতে গণ্য। তাই সমাজের আসন পেতে অর্থের ঝনঝনানি দরকার। অর্থ যেখানে  সামাজিক মর্যাদার প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে মহান পেশার মানুষগুলো লোভ-লালসায় নীতিহীন কাজে জড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকের কাছে ছাত্রী ধর্ষণও একই কারণ মাত্র।


আজ শিক্ষক পদে কাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে? আর নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বা কী? এ দুই বিবেচনা করলেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে  এধরনের  অভিযোগ অস্বাভাবিক মনে হবে না। সমাজের আর দশটা পেশার মানুষের মতই শিক্ষক নামের পেশাজীবীদেরও নিয়োগ নীতি কোন ব্যতিক্রম বিষয় নয়। একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর কোন উচ্চতর প্রশিক্ষণ হয় না। শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বড়জোড় নামমাত্র কিছু প্রশিক্ষণ হলেও তা কাজের নয়। একজন শিক্ষক আসলে কে, তার আচরণ কী হওয়া উচিত, সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে তার কেমন প্রভাব এমন নৈতিকতার শিক্ষা তাকে দেয়া হয় না। 

এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব আর ঘুষের বিনিময়ে অন্যসব চাকরির মতই শিক্ষকতারও চাকরি হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তো বটেই, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতার চাকরির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের প্রয়োজন হয় না। আর তা চালু হলেও লাভ নেই। অর্থ বা দলীয়করণের ক্ষমতায় চরম বিতর্কিত ব্যক্তিটির চরিত্র ফুলের মত পবিত্র হতে  কাগজপত্রে সময় লাগে না।

তাই বলে নৈরাশ্যের কথা নয়। এবারে আসি সমাধানে কিছু পরমর্শ নিয়ে।  একটি জাতিকে ধংস করতে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধংস করাই যথেষ্ট। আমাদের দেশেও আস্তে আস্তে তাই হচ্ছে। তবে এখনও সময় আছে নিজেদের শুধরে নেয়ার। একমাত্র শিক্ষকরাই সমগ্র জাতিকে আলোর পথ দেখাতে পারেন। শিক্ষকরা তার শিক্ষার্থীর কাছে অনুসরনীয়। তাই দেশের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন পন্থায় হওয়া উচিত। সবার আগে মেধায় হতে হবে নিয়োগ। সেই সাথে নিয়োগ উত্তীর্ণদের পরিবারিক সংস্কৃতি, ব্যক্তির আচরণ, সভ্যতা ও চর্চার বিষয় নিয়ে সঠিক তদন্তের পর শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর নিয়োগের পরে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ। সেখানে একজন শিক্ষককে বুঝিয়ে দিতে হবে তিনি সমাজ গড়ার করিগর। আর দশজনের মত তিনি নয়। অনেক ত্যাগী হতে হবে তাকে। তিনি সমাজের আদর্শ, জাতির অনুকরণ। আর সেই সাথে জীবন জীবিকার যুদ্ধে পরিবার নিয়ে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার সুযোগ সুবিধাও যোগাতে হবে রাষ্ট্রকে। সমাজে শিক্ষকের উন্নত মর্যাদার ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর অপরাধে প্রয়োজন প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে শিক্ষকদের জন্য পৃথক আইন করে কঠোর শাস্তি বিধানের।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক

[ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে - dainik shiksha একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের - dainik shiksha ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম - dainik shiksha থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান - dainik shiksha প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046989917755127