বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র

একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার |

ড. আকবর আলি খান সমসাময়িক আমলের এক ঝড়তোলা আমলা, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী,  ন্যায়পন্থী কন্ঠস্বর, নন্দিত লেখক এবং বরেণ্য অর্থনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত অন্য কোনো আমলা তার মতো জন নন্দিত হননি। তিনি স্বীয় গুণে সর্বস্তরের মানুষের আস্থা, সম্মান ও ভালোবাসায় সিক্ত হন। তিনি ছিলেন সৎ, সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী, উদারমনা ও সাদা মনের মানুষ। তিনি ছিলেন এক সাচ্চা দেশপ্রেমিক। যৌবনে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রৌঢ়ত্বে সময় সততা, নিষ্ঠা, স্বেদ, মেধা ও দক্ষতার সাথে সুশীল সেবক হিসেবে দেশের জন্য কাজ করেন। বার্ধ্যকে দেশের কল্যাণে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তাই সর্বমহলে তিনি ‘জাতির  বিবেক’ নামে খ্যাত হন।

ড. আকবর আলি খান গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি আর ফিরে আসবেন না। আমাদের সাথে তাঁর আর দেখা হবে না। মানুষও তাঁকে ভুলে যাবে। তবে উত্তম চর্চার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিশ্চয় তাঁকে পুরস্কৃত করবেন। 

ড. আকবর আলি খান এবং আমি : আমি সিভিল সার্ভিসে যোগদান করি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর। আকবর আলি খানকে প্রথম দেখি ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে। তিনি তখন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব। আমরা তখন শাহবাগের সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে (কোটা) বুনিয়াদি ট্রেনিং করি। তিনি আমাদের উদ্দেশে ওয়াটার রিসোর্স-এর ওপর বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। অতঃপর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের আগ পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমি একই বছরের ১০ জুলাই ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করি। ফরিদপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগে
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আন্তরিকতার সাথে কিছু পরামর্শ দেন। 

ফরিদপুরে ডিসি থাকা অবস্থায় কয়েকবার ফোনে কথা হয়। ২০০৭-০৮ খ্রিষ্টাব্দে আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলাম। মন্ত্রী (উপদেষ্টা) ছিলেন ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের সিএসপি আইয়ুব কাদরী। তখন আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে ড. আকবর আলি খান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ এবং অধ্যাপক হাসান ওয়াইজকে সম্মানিত অতিথি করা হয়। আমার সভাপতিত্বে শাহবাগে  বিসিএস প্রশাসন একাডেমির অনুষ্ঠানে তাঁরা তিনজনই উপস্থিত ছিলেন। 

আমি ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে লেখালেখি শুরু করি। আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘শেকড় লতাপাতা ও  ঠিকানা’। এটি সামাজিক ইতিহাসবিষয়ক বই। বইয়ের একটি কপি ড. আকবর আলি খানকে পাঠিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে একটি ছোট্ট চিঠিতে লিখেছিলেন: আউয়াল, আপনার বইটি আমি  দেখেছি। আপনার লেখার হাত ভালো। লেখালেখিটা বন্ধ করবেন না। 

অতঃপর মাঝে মাঝে কথা হতো। শেষ কথা হয় চলতি বছরের ৭ আগস্ট সকাল ১১টায়। ওইদিন লোপা খানের বিষয়ে আলোচনা হয়। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে আমার লেখা ২১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। 
এসব বই লখার ক্ষেত্রে যাঁরা আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাঁদের মধ্যে আকবর আলি খান  স্যার অন্যতম। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। 

আকবর আলি খানের পরিচিতিঃ আকবর আলি খান ১৯৪৪ খ্র্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রসুল্লাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অ্যাডভোকেট আমির আলি খান, মায়ের নাম হাজেরা খান। তিন ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোট দুই ভাই জসীম উদ্দিন খান এবং কবির উদ্দিন খান যথাক্রমে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এবং  নাভানা গ্রুপে চাকরি করতেন।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নবীনগর হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট এবং ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম

শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পাস করেন। এরপর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে এমএ (১৯৭৭) এবং একই বিষয়ে পিইচডি (১৯৭৯)করেন।

কর্মজীবন : এমএ পাস করার পর  তিনি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাচে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। পরে সিভিল সার্ভিস থেকে লিয়েন নিয়ে কিছুদিন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

সিভিল সার্ভিসের জীবন: তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর সিএসপি অফিসার হিসেবে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বিধায় দু বছরের ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা পান। ফলে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী যোগদানের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট। তিনি সক্রিয় চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা আগস্ট। তাঁর মোট সক্রিয় চাকরিকাল ৩৩ বছর ৯ মাস ১৫ দিন। তবে নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর চুক্তিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে ৮ মাস এবং বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প পরিচালক হিসেবে ৩ বছর চাকরি করেন।

ড. আকবর আলি খান ১৯৬৭ ব্যাচের সিএসপি অফিসার ছিলেন। এ ব্যাচের বিশ জনের সম্মিলিত মেধা তালিকায় আকবর আলি খান ছিলেন দ্বাদশ। বাঙালিদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল পঞ্চম। শাহেদ সাদুল্লাহ চলে যাবার পর আকবর আলি খান চতুর্থ স্থানে আসেন।

ড. আকবর আলি খানের উল্লেখযোগ্য পদায়নসমূহ: সহকারী কমিশনার, রাজশাহী, মহকুমা প্রশাসক, হবিগঞ্জ, উপসচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জন প্রশাসন  মন্ত্রণালয়, যুগ্মসচিব পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, অতিরিক্ত সচিব, অর্থ  বিভাগ  এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সচিব, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সচিব,  অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ/চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সচিব, অর্থ বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিকল্প  পরিচালক,  বিশ্ব ব্যাংক।

আকবর আলি খান বাংলাদেশের অর্থ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মন্ত্রী (উপদেষ্টা) ছিলেন। এসব ছিল তাঁর পদবি। অপকর্ম করলে পদ অমর্যাদার উৎসে পরিণত হয়। তখন ব্যক্তি নিচে নেমে যায়। সুকর্ম করলে পদধারী মানুষটি পদের চেয়েও উঁচুতে উঠে যান।

আকবর আলি খান জীবনভর সুকর্ম করার চেষ্টা করতেন। তাই পদকে আড়াল করে তিনি হয়ে ওঠেন এক মহীরুহ। তিনি ছিলেন সকল সুকর্মের কাজী, এক সব্যসাচী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। পরকালে তিনি ভালো থাকুন। তাঁর পরিবার-পরিজন শোক সহ্য করার শক্তি লাভ করুন। আমিন।

ড. আকবর আলি খান, হামিম খান এবং নেহেরীন খান। এখন তিনজনই পরপারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তিনজনকেই জান্নাতবাসী করুন। আমিন।


লেখক : সাবেক সচিব, লেখক, গবেষক  

[ লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে - dainik shiksha কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা - dainik shiksha ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন - dainik shiksha সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল - dainik shiksha ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে - dainik shiksha নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060179233551025