বাংলা তারিখ : বদলাচ্ছে ৫৬৮ বছরের রীতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রশাসনে বাংলা তারিখের ঠাঁই সামান্যই। সেই সামান্যতেও কাঁচি চালানো হচ্ছে। বাংলা সনের কার্যকর ব্যবহারের শেষ জায়গাটি থেকেও সরে আসছে সরকার। 

বর্তমানে জমির খাজনা আদায় করা হয় বাংলা তারিখ অনুযায়ী। কিন্তু ভূমি উন্নয়ন কর আইন সংশোধন করে বাংলার বদলে ইংরেজি অর্থবছরে কর আদায় করা হবে। গত ২৮ মার্চ আইনটি নীতিগত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। যা সংসদে পাস হলে বদলে যাবে ৫৬৮ বছরের প্রচলিত রীতি।

আজ ১৪ এপ্রিল দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফুল হক। 

বিস্তারিত পড়ুন: সরকার কেন সুদীর্ঘকালের রীতি ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খলিলুর রহমান বলেছেন হিসাবসংক্রান্ত সুবিধার কথা। অর্থবছরের সঙ্গে বাংলা সনের মিল নেই। মাঠপর্যায়ে এ খাত থেকে বাংলা সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে সমস্যা হয়। সেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার জন্য এ আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

গত প্রায় এক দশক ধরে ভূমি উন্নয়ন কর আইন সংশোধন নিয়ে কাজ করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। শুরু থেকেই কর্মকর্তারা বাংলা বর্ষপঞ্জিমতে ভূমি কর আদায়ের ধারাটি বদলে ফেলার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে নানা মত ছিল কর্মকর্তাদের মধ্যে। খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরও ভিন্নমত রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার মতে, এ ধারাটি বহাল রাখা যেত ঐতিহ্যের স্বার্থে। বাংলার বদলে ইংরেজি খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী কর আদায় করলে সরকারের কর যা আছে তাই থাকবে। এ রেওয়াজটা বদলে ফেলা হলে দেশ থেকেই কার্যকরভাবে বাংলা তারিখের ব্যবহার উঠে যাবে। বর্তমান ধারায় এমন কোনো আর্থিক বিশৃঙ্খলা হয় না। শুধু হিসাবটা ইংরেজির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই হয়। বাংলার স্বার্থে এ মিলিয়ে নেওয়ার জটিলতাটুকু মেনে নেওয়া উচিত।

এসব কর্মকর্তার মতে, ২০১৯-২০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির জানুয়ারি-ডিসেম্বর অনুযায়ী বাজেট ঘোষণার আলোচনা উঠেছিল। তাদের যুক্তি ছিল অর্থবছরের (জুলাই-জুন) প্রথম কয়েক মাস বর্ষা থাকায় সময়ভিত্তিক উন্নয়নকাজ শুরু করা যায় না। বাজেট ঘোষণা ইংরেজি বর্ষপঞ্জির শুরুর মাসে হলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুবিধা হবে। কিন্তু তাদের এ প্রস্তাব আমলে নেয়নি সরকারের নীতিনির্ধারক মহল।

গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান সাংবাদিকদের জানান, মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই আইনানুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের বর্ষ অর্থবছর (জুন-জুলাই) অনুযায়ী হবে। বর্তমানে তা বাংলা সন (বৈশাখ-চৈত্র) অনুযায়ী হচ্ছে।

ঢাকা বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরাই ভূমি কর আদায় করি। যত জটিলতার কথা বলা হচ্ছে, বিষয়টি আসলে তত জটিল নয়। রেওয়াজ ভেঙে এটা ইংরেজি বর্ষে আনলে কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। তাহলে কেন দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ভাঙতে হবে। আমর মনে হয় প্রধানমন্ত্রী এটা জানেন না। তিনি জানলে বিষয়টি মানবেন না বলে আমার বিশ্বাস।’

ভূমি উন্নয়ন কর ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে বাংলা সনের প্রচলন রয়েছে। কিন্তু এসবের ব্যবহার ভূমি উন্নয়ন করের মতো সর্বব্যাপী নয়, খুবই নির্বাচিত কিছু মানুষ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সরকারের প্রকাশনা গেজেটে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা তারিখ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। ২০ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণার যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তার ডানদিকে তারিখ রয়েছে। ওপরের তারিখটি বাংলায় এবং নিচের তারিখ ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য গেজেটেও একই প্রক্রিয়ায় বাংলা এবং ইংরেজি উভয় তারিখ উল্লেখ করা হয়। মৎস্যজীবীদের মধ্যে জলমহাল ইজারা দেওয়া হয় বাংলা তারিখ অনুযায়ী। বালুমহালও ইজারা দেওয়া হয় একইভাবে। হাট-বাজারের ইজারাও দেওয়া হয় বাংলা তারিখ অনুযায়ী।

ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বর্ষপঞ্জি বদলাতে পারলে ভবিষ্যতে তারা বালুমহাল, হাট-বাজার ইজারা দেওয়ার বর্ষপঞ্জিও বদলানোর চেষ্টা করবেন বলে আশঙ্কা করছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা।

ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরি বর্ষ অনুসারে খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। ফলে অসময়ে কৃষকদের খাজনা দিতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন।

ইতিহাস অনুসারে বাংলা সনের প্রবর্তনের সময় ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকে। ওই খ্রিষ্টাব্দেই আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আদিল শাহ শুরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন।

বাদশাহ আকবর তার সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজির সহযোগিতায় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। সে সময় কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

নতুন এ খ্রিষ্টাব্দ আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকেই, কারণ ওইদিনই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।

ইতিহাসের এ ঘটনা টেনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন, কী দরকার ৫৬৮ বছরের ইতিহাস বদলের। যেকোনো জাতীয় দিবসে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা তারিখ ব্যবহার করতে হাইকোর্টের রুল রয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এ রুল দেওয়ার পর প্রশাসনে বাংলা তারিখের ব্যবহার কিছুটা বেড়েছে।

জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্ণিলভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করলেও বাংলা সন কিংবা বাংলা তারিখ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে উপেক্ষিত। অনেকে জানেই না বর্তমানে কোন বাংলা সন চলছে কিংবা কোন বছর শুরু হতে যাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে বাংলা উপেক্ষিত থাকার কারণেই মূলত এটি ঘটছে। বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলা সন কিংবা তারিখের যেন কোনো মূল্য নেই। স্কুল-কলেজের বাৎসরিক সূচি শুরু হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে। কর্মজীবীরা তাদের বেতন পান ইংরেজি মাসের প্রথম সপ্তাহে। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বাসা বেঁধেছে। আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করছি না। একটু চেষ্টা করলেই আমরা আমাদের জীবনে বাংলা সন এবং তারিখের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করতে পারতাম। কিন্তু আমরা শুধু অন্যদের নকল করে গেছি। নিজেরা কিছু সৃষ্টি করিনি। তাই আজ এ অবস্থা। চাইলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মজীবীদের বেতন বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া যায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি বাংলা সনের প্রথম মাস থেকে শুরু করতে কোনো সমস্যা নেই। এ দুটো কাজ করা গেলে বাংলা সন এবং তারিখ মনে রাখতে আমরা বাধ্য হব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022599697113037