বাংলা বর্ণ চেনে না তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির অর্ধেক শিক্ষার্থী

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

পাঠ্যক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিকেই বাংলা বর্ণমালা ও গণিতের ১ থেকে ২০ পর্যন্ত শিখে ফেলার কথা। অথচ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অনেক শিক্ষার্থীরই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে সমস্যা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। কভিডে দুই বছর স্কুল বন্ধ থাকার পর প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অবস্থা এখন কোন অবস্থায় রয়েছে, তা জানতেই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। 

কভিড মহামারী শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় দেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে বলে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে পুরো একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা যখন স্কুল বন্ধ থাকে, তখন শিশুরা শেখার ও বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় সুযোগটি হারায়। সেটিই প্রকাশ পেয়েছে বিআইডিএসের গবেষণায়। দেশের ৩৩৯টি উপজেলায় গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালনা করে সংস্থাটি।

এর মধ্যে গ্রামীণ, শহুরে, চর ও উপকূলীয় এবং পাহাড়ি এলাকার ২০ হাজার বিদ্যালয়ের মধ্য থেকে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ১ হাজার ৬৪৪টিকে বাছাই করা হয়। যেখানে ৭২ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল গ্রামাঞ্চলের এবং ৭ দশমিক ৩ শতাংশ শহরের বিদ্যালয়। এছাড়া চর ও উপকূলীয় এলাকার বিদ্যালয় ছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাহাড়ি এলাকার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। একই পদ্ধতিতে এসব বিদ্যালয় থেকে নির্বাচন করা হয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৬২ হাজার ৭০৩ শিক্ষার্থীকে, যারা কভিডের সময় অটো পাস নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে উঠেছে। বাংলা ও গণিতে দক্ষতার ওপর তাদের মূল্যায়ন করা হয়। 

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘৬৪ জেলার ৬২ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর জরিপটি চালানো হয়। এটা অনেক বড় একটি গবেষণা। তাতে দেখা গেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীই জটিল (কমপ্লেক্স) বাক্য ও শব্দ পড়তে পারে না। এটা আমাদের শিক্ষার সংকটকে নির্দেশ করে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছতে হলে আমাদের শিক্ষার এ সংকট দূর করতে হবে।’

গবেষণা দলের সদস্য ছিলেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এসএম জুলফিকার আলী, রিসার্চ ফেলো সিবান শাহানা ও রাশদ-ই মাতিনা। তারা জানান, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে প্রশ্নপত্র নকশায় কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়। শ্রেণির ধরন এবং পাঠ্যক্রম অনুযায়ী যেসব শেখানো হয় তার ওপর ভিত্তি করে প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করা হয় ১০টি। এর মধ্যে আটটি বাংলার এবং আটটি গণিতের প্রশ্ন করা হয়। এছাড়া এ আটটি প্রশ্নের কোনো কোনোটিতে এক বা একাধিক প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয় শ্রেণির ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের আলাদা করে বাংলা বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর বাছাই করতে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে দেখা হয় যে ওই শব্দের সঙ্গে তারা কতজন পরিচিত। 

সহজ ও কঠিন শব্দ পড়তে পারে কিনা তা যাচাই করা হয় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর। এ মূল্যায়নে ৩১ হাজার ৬৪৫ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তাদের মোট তিনটি শব্দ দেয়া হয়, তার মধ্যে একটি ছিল কঠিন বর্ণ দিয়ে গঠিত। তবে একটি শব্দও পড়তে পারেনি চতুর্থ শ্রেণির ২ হাজার ২১৭ শিক্ষার্থী (৭ শতাংশ)। তিনটি শব্দের মধ্যে মাত্র একটি পড়তে পেরেছে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ১৬৮ শিক্ষার্থী। মাত্র দুটি শব্দ পড়তে পেরেছে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ বা ১৯ হাজার ১৪২ শিক্ষার্থী সব শব্দ পড়তে পেরেছে। 

কঠিন বানানের তিনটি শব্দও দেয়া হয় তাদের। যেখানে একটিও পড়তে পারেনি এমন শিক্ষার্থীর হার ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। একটি শব্দ পড়তে পেরেছে কেবল ১৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৩৯৩ শিক্ষার্থী। দুটি শব্দ পড়তে পারে কেবল ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সব বানানই পড়তে পারে এমন শিক্ষার্থীর হার ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ।

দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যারা শিক্ষাদানে নিয়োজিত, তাদের বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা থাকলেও তা কাটিয়ে উঠতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পান না। এমনকি নিয়মিত ক্লাস নিলেও শিক্ষকদের একটি বড় অংশই নিজেদের জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে সম্প্রতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কোনো জিজ্ঞাসা এলে নিজের মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এতে শিশুরা ভুল শিখছে।  

বিআইডিএসের কভিড-পরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে করা বিশেষ গবেষণায় তৃতীয় শ্রেণির ৩১ হাজার ৫৮ এবং চতুর্থ শ্রেণির ৩১ হাজার ৬৪৫ শিক্ষার্থীকে পুরো একটি লেখা পড়তে দেয়া হয়। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো লেখাটা একেবারেই পড়তে পারেনি ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ বা ১১ হাজার ৩৯৭ জন। আবার পড়তে পেরেছে কিন্তু জড়তা আছে এবং বিরাম চিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে না, এমন শিক্ষার্থীর হার ছিল ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া সাবলীলভাবে লেখাটা পড়তে পারে এবং বিরাম চিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করতে পেরেছে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। একই পরীক্ষায় চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো লেখাটা একেবারেই পড়তে পারেনি ৩০ দশমিক ২ শতাংশ বা ৯ হাজার ৫৬০ শিক্ষার্থী। 

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গণিতের বিভিন্ন নম্বর চিনতে ও যোগ করতে পারে কিনা তার ওপরও মূল্যায়ন করা হয়। এর মধ্যে কোনো নম্বরই চিনতে পারে না এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮৪ জন বা ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এক্ষেত্রে ছেলেদের (১ হাজার ৬৫৫ জন) চেয়ে মেয়েদেরই (২ হাজার ৪২৯) অংকে কাঁচা মনে হয়েছে। তিনটির একটি নম্বরও চিনতে পারেনি এ রকম শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। তিনটির মধ্যে দুটি নম্বর চিনতে পারে এমন শিক্ষার্থী ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ বা ৫ হাজার ৯৭০ জন। এছাড়া সব নম্বরই চিনতে পেরেছে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। 

এসব শিক্ষার্থীকে দুই ধরনের যোগ করতেও দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে এক ধরনের যোগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো উত্তর দেয়নি এবং ভুল করেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। আরেক ধরনের যোগের ক্ষেত্রে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো উত্তরই দেয়নি এবং ভুল করেছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তাদের ভাগ করতে দেয়া হলে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তরই দেয়নি। আবার উত্তর দিলেও ১৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুল করেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি শিক্ষার্থীদের বর্ণ ও সংখ্যা না চেনার তথ্য খুবই দুঃখজনক। এ ধরনের গবেষণাকে আমলে নিয়ে আরো বড় গবেষণা হতে পারে। পাশাপাশি গবেষণায় উঠে আসা চিত্রে পরিবর্তন আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা এ ধরনের মৌলিক ঘাটতি নিয়ে শ্রেণি পার করলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005856990814209