বাংলা বানান নিয়ে কিছু কথা

মাসুদ আনোয়ার |

সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার আগে কিছুদিন জীবন বিমার দালাল হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমার এক আত্মীয় সরকারি বিমা অফিসের বড় কর্মকর্তা। তার মাধ্যমে দালালিতে হাতে খড়ি। ভদ্রলোক প্রথম দিন আমাকে হাতে কলমে বিমা সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করলেন। সেখানে  লিখলেন, ‘বিমার বিভিন্ন ধরন আছে। একধরনের বিমা হলো ‘আয়জীবন’ বিমা।’

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আয়জীবন মানে? শব্দটা সম্ভবত ‘আজীবন’ হবে, কী বলেন?’

ভদ্রলোক একটু থমকে গিয়ে বললেন, ‘হতে পারে। কিন্তু আমরা তো বানান শিক্ষার আসরে বসিনি। আমরা বিমা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।’ তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, ‘বাংলা আমাদের ভাষা। ভুল বানানে লিখলেও আমরা বুঝতে পারি। খেয়াল রাখবে ইংরেজি বানানটা যেন ভুল না হয়।’মোক্ষম কথা। অগত্যা চুপ করে গেলাম।

বাংলায় বানান ভুলের এ মহড়া সর্বত্র। এমনকী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্ররাও এ মহড়া থেকে মুক্ত নন। আপনি যদি লেখেন, ‘সে ভাত খাই’, তাহলে তেমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু ইংরেজিতে লেখেন, ‘He eat rice.' তাহলে কিন্তু বিদ্রুপ আর বকুনি ধেয়ে আসবে ভিমরুলের মতো। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আপনি বাংলা বানান ভুল করে তেমন কোনো লজ্জা পাবেন না, কিন্তু ইংরেজি বানান ভুল করলে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলবেন।

এটা হলো আমাদের দাস্য মনোভাবের একটা প্রমাণ। ব্রিটিশ আমলে যেমন যে যত বেশি ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারতেন, তিনি সাহেবদের কাছে তত বেশি বাহবা পেতেন। সমাজে তারাই হতেন অভিজাত। আর সংস্কৃত বা ফার্সি ভাষায আপনার অসামান্য দক্ষতাও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বড় কোনো কাজে লাগত না। এতে করে এ শ্রেণির শিক্ষিতদের মধ্যে একটা হীনন্মন্যতার ভাব সৃষ্টি হতো। ওদিকে সাহেবদের কাছে বাহবা প্রত্যাশীরাও ইংরেজিতে বানান ভুলের ব্যাপারে দারুণ সতর্ক থাকতেন। তারা বাংলা বানানে শতকরা ৫০টা ভুল করলেও বিব্রত হতেন না। ভাবতেন, বাংলা তো আর সাহেবরা দেখতে পাবেন না। সুতরাং তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আবার কেউ কেউ বাংলা বানান সঠিকভাবে না জানাটাকেই মনে করতেন একধরনের ক্রেডিট। কালক্রমে এটা আমাদের মনে একধরনের সংস্কার কিংবা আতঙ্ক হয়ে সুপ্ত হয়ে রইল। না, বাংলা ভুল হোক, কিন্তু ইংরেজিতে বানান ভুল করা যাবে না। সে হবে লজ্জার।

আমি আতঙ্কের সঙ্গে দেখি, যখন আমাদের শিক্ষকরাও বাংলা বানান ভুল করে থাকেন। আমাদের সাংবাদিকরাও দিব্যি ভুল বানানে ভুল বাক্যে রিপোর্ট লিখে যান। এ বিষয়ে কিছু বলা হলে অবলীলায় বলে দেন, বানান টানান ঠিক করা সাব এডিটরের কাজ। এছাড়াও প্রুফ রিডাররাও তো আছেন। এটা প্রকারান্তরে শুদ্ধ বানানে লেখার যে প্রবণতা বা দায় থাকা উচিত, তাকেই উপেক্ষা করা। এটা ঠিক নয়, এর প্রভাব পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও। ভাষার বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়ার বীজ উপ্ত হয় এ অবজ্ঞা বা উদাসীনতা থেকেই। অনেক কবি-সাহিত্যিককেও দেখেছি ভুল বানানে দিব্যি ....।

তবে আামি বেশি করে দায়ী করব শিক্ষকদেরই। কারণ শিক্ষকরাই সরাসরি ছাত্রদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। ছোট একটা স্কুলের শিশু পড়াশোনার ব্যাপারে তার বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকদেরই বেশি বিশ্বাস করে থাকে। কোনো কোনো বাচ্চা এমনও বলে থাকে, ‘তোমরা আমার টিচারের চেয়ে বেশি জান নাকি?’ 

সে ক্ষেত্রে বাবা-মা পড়েন উভয় সঙ্কটে। বাচ্চাকে এটা বলতে পারেন না যে, তোমার টিচার ভুল করেছেন। এরপর ফল হবে শিশু শিক্ষার্থী তার শিক্ষকদের প্রতি অনড় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা দুটোই হারাবে। তার কোমল মনে সৃষ্টি হবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। বাবা-মার ভুল তার মনে তেমন কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি নাও করতে পারে। কিন্তু শিক্ষকের ভুল তার মনের ভূমি থেকে শিক্ষকের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধার শেকড়গুলো উপড়ে ফেলবে। অথচ এর পরেও শিক্ষকদের কাছেই তাকে পড়তে হবে।

সব শিক্ষকই যে বানান ভুল করেন, তা নয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশিরভাগ শিক্ষকই তা করে থাকেন--এবং করে থাকেন একধরনের অমনোযোগিতা ও অসচেতনতা থেকে। জবাদিহি বা দায়বদ্ধতা না থাকার কারণেই সেটা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। অবশ্য শুধু শিক্ষকরাই নন, সমাজে বা রাষ্ট্রে উঁচু পদে আসীনরাও এ রোগ থেকে মুক্ত নন। তবে বানান ভুলের রোগে ভুগেও তাদের ধারণা, তারা দিব্যি সুস্থ আছেন।

বানান ভুলের এ ব্যাধি সারানোটা অবশ্য খুব যে কষ্টসাধ্য তা নয়।

বলা হয়ে থাকে, বাংলা বানানে ভুল হওয়ার কারণ এর বর্ণবহুলতা। একটা ‘স’ একটা ‘র’ কিংবা একটা ‘জ’ হলেই তো চলে। আবার ‘ই-কার’ কিংবা ‘ঈ-কার’ কিংবা ‘উ-কার’ কিংবা ‘উ-কার’ কেন? এটা আপাতঃ সত্য মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি যখন একটা ভাষার প্রবণতা কিংবা বৈশিষ্ট্যের দিকে খেয়াল করবেন, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ইংরেজিতে But আর Put সমবানানে লেখা হলেও উচ্চারিত হয় ভিন্নভাবে। এতে ইংরেজি ভাষার লেখনে খুব একটা সমস্যা হয় না। দেখতে দেখতেই অভ্যস্ততার ব্যাপারটা এসেই যায়। ব্যাপারটা নির্ভর করে আপনি কতটা মনোযোগী তার ওপর।

বানান শিক্ষার ব্যাপারটা এখন ধরতে গেলে শিক্ষার্থীদের ওপরই ছেড়ে দেয়া হয়। এতে খুব কম শিক্ষার্থীই ব্যাপারটা আত্মস্থ করতে পারে। তারা বানান ভুল করে না। কিন্তু যারা পারে না, তারা সারা জীবনই ভুল করে। এ সমস্যা কাটানোর জন্য তেমন উদ্যোগও নেয়া হয় না। পরীক্ষার খাতায় তিনটা বানান ভুলের জন্য এক নম্বর ‘কাটা’ যাওয়ার মধ্য দিয়েই শাস্তি শেষ। এতে কতটা প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের মনে, তারা কতটা সচেতন হয়, তার কোনো হিসেব থাকে না।

শিক্ষার্থীদের বানান ভুল থেকে মুক্ত করার জন্য বানান নিয়ে কাজ করার বিকল্প নেই। বিদ্যালয়ে প্রথম দিককার ক্লাসগুলোতে বানান শেখার ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। একটা ক্লাস থাকতে পারে, যে ক্লাসে শিশুদের বানানবিধি শেখানো এবং চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। ণত্ব বিধি ও ষত্ববিধি নামে ব্যাকরণে বানানের কিছু সূত্র থাকলেও ‘ই-কার’ কিংবা ‘ঈ-কার’ কিংবা ‘উ-কার’ কিংবা ‘উ-কার’ ব্যবহারের বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। এসব বানানসহ অন্যান্য খটকার বানানগুলোতে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে তুলতে নিয়মিত ক্লাস নেয়া যেতে পারে। 

এভাবে, মনে হয় কেবল এভাবেই যারা স্নাতক পাস করেও ‘আজীবন’কে ‘আয়জীবন’ লেখেন, তাদের হাত থেকে বাংলাভাষাকে নিষ্কৃতি দেয়া যেতে পারে।

লেখক : মাসুদ আনোয়ার, সাংবাদিক ও লেখক ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005842924118042