বাঘিনীর গর্জনে কাটছে মেঘ

আজাদ মজুমদার |

মুস্তাফিজুর রহমানকে তো সবাই চেনেন। হালে তার পারফর্মেন্সে কিছুটা টান পড়লেও কিছুকাল আগেও, পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন তিনিই। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধূমকেতুর মতো তার আবির্ভাব। শুরুটা পাকিস্তানের বিপক্ষে একটা টি-টোয়েন্টি দিয়ে হলেও মুস্তাফিজকে আসলে সবাই চিনেছেন একই বছর ভারত বধের পর।

এখন থেকে আপনাকে হয়তো মারুফা আক্তারকেও একইভাবে চিনে রাখতে হবে। মুস্তাফিজের মতোই হইচই ফেলে দেওয়া একটা কাজ যে মারুফাও করেছেন। পেস বোলিংয়ের তোপ দাগিয়ে হারিয়েছেন ভারতকে। ১৬ জুলাই ২০২৩, নারীদের ওয়ানডে ম্যাচে মারুফার কৃতিত্বে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ যে জয় পেয়েছে এক হিসেবে তা মুস্তাফিজদের কৃতিত্বের চেয়েও বড়। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে প্রতিবেশী দেশের বিপক্ষে এটাই প্রথম জয়।

যে মারুফার কৃতিত্বে এই জয় এসেছে একদিন তিনি মুস্তাফিজুর রহমানের চেয়েও বড় পেস বোলার হবেন এমন ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক ক'দিন আগেই এক অনুষ্ঠানে করেছিলেন বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি।

ঠিক কী মনে করে মারুফাকে বোঝাতে মুস্তাফিজকে তিনি তুলনায় টেনেছিলেন তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে ঘটনার কাকতাল কিংবা আর যাই হোক, এই দু'জন যে অন্তত একটা ক্ষেত্রে একই সমান্তরালে এসে গেছেন এটাই এখন সত্য। 

এরপরের সত্যটা কী হবে সেটাও একরকম জানাই। ভারতকে হারিয়ে মুস্তাফিজের পৃথিবীটা রাতারাতি বদলে গেছে। আইপিএল-এ ডাক পেয়েছেন। ইংলিশ কাউন্টি দলেও খেলেছেন। আর বাংলাদেশের হয়ে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটতো আছেই।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে মুস্তাফিজকে মোটামুটি ধনীই বলা যায়। শুরুর কৃতিত্বে সমান হলেও শেষের অর্জনে মারুফা তার ধারে কাছেও যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্তত এই সময়ের বাস্তবতাকে মাথায় রাখলে এটা অনায়াসেই বলে দেওয়া যায়।

করোনার সময় এই মারুফার একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। নীলফামারীতে কৃষক বাবার পাশের জমিতে মই টানছিলেন। বাংলাদেশের গরিব পরিবারের অনেক মারুফারাই এই ধরনের কাজে বাবাকে সহায়তা করেন। কিন্তু তার ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল কারণ ততদিনে ক্রিকেটার হিসেবে তার সম্ভাবনার কথা অনেকেই জেনে গিয়েছিল।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন, পরের বছরই প্রিমিয়ার লীগে মোহামেডান নারী দলে খেলে ফেলেন। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটাও ছিল একরকম অবধারিতই। এমন একজন সম্ভাবনময়ী নিজের আসল কাজ রেখে হালের মই টানছেন তা ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অনেককেই ব্যথিত করেছে।

মারুফা কিছুটা ভাগ্যবতী। ছবি ভাইরাল হওয়ায় তার পরিবারের করোনাকালীন সংগ্রাম বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নজরে এসেছে। তিনিও দারিদ্র্যকে ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেটে ফিরতে পেরেছেন। আর এখনতো রীতিমতো তারকা বনে গেছেন।

মাঠের মতোই দারিদ্র্যের বিপক্ষে তার লড়াইও এবার হয়তোবা কিছুটা জ্বলুনি পাবে। কিন্তু একটু আগেই যে কথা বলছিলাম, তার আর্থিক সমৃদ্ধি কি মুস্তাফিজের মতো হবে? কিংবা জীবন একইভাবে বদলে যাবে?

আপাতত যা পরিস্থিতি, সেই সম্ভাবনা নিয়ে বাজি ধরার লোক খুব একটা পাওয়া যাবে না। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের চলমান বৈষম্য ক্রিকেটেও যে তা দৃষ্টিকটুভাবে বিরাজমান। যদিও বাংলাদেশ নারী দলের এগিয়ে যাওয়ার গতি পুরুষদের চেয়ে খুব বেশি কম নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা এগিয়েই আছে। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ পুরুষ দল তিনবার ফাইনালে উঠেও জিততে পারেনি। নারীরা কিন্তু প্রথমবারেই বাজিমাত করেছে এবং তা এই ভারতেরই দীর্ঘ আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে।

ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের এই সিরিজ যখন চলছিল, অনেকের অলক্ষ্যেই বিশ্ব ক্রিকেটে বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় নিজেদের বার্ষিক সাধারণ সভা থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা আইসিসি ঘোষণা করেছে, এখন থেকে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলো পুরুষদের সমান প্রাইজ মানি নারীরাও পাবে।

বিশ্ব ক্রিকেটে নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসানে এটা বড় পরিবর্তনের সূচনা করবে বলেই ধারণা করি। কিন্তু বাংলাদেশে এই পরিবর্তনের হাওয়া কবে লাগবে সেটা বলা মুশকিল। এর একটা বড় কারণ, বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট জেতার অবস্থানে শুধু নারীরা কেন, বাংলাদেশের পুরুষরাও এখনো যেতে পারেনি। 

বাংলাদেশের তাই ভিন্নভাবে ভাবা ছাড়া উপায় নেই। সামনে বাংলাদেশের সামনে কিছু উদাহরণও আছে। নিউজিল্যান্ড পুরুষ এবং নারীদের সমান বেতন দিচ্ছে। ভারত দিচ্ছে সমান ম্যাচ ফি। এই বিষয়গুলো নিয়ে যে বাংলাদেশেও একেবারেই কোনো আলোচনা হয়নি তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সাম্প্রতিক এক সভায় কেবল নারীদের ২০ ভাগ বেতন বাড়িয়েই দায় সেরেছে।

নিউজিল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও কেন পুরুষ ও নারীদের একই বেতন দেওয়া যাবে না সেই প্রশ্নে বিসিবির একজন বড় কর্মকর্তা অদ্ভুত একটা যুক্তি দেখিয়েছেন কিছুদিন আগে। তার কথা—নিউজিল্যান্ডে নারীদের খেলায় সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। বাংলাদেশে নারীদের খেলা গাঁটের পয়সা খরচ করে কে দেখতে আসে?

না বলে উপায় থাকছে না, দর্শক উপস্থিতি কিংবা গেট মানিই যদি বাড়তি বেতন পাওয়ার একমাত্র কারণ হয় তবে তো বাংলাদেশ পুরুষ দলেরও খুব বেশি বেতন হওয়ার কারণ নেই। খুব বড় কোনো সিরিজ না হলে গ্যালারি এখন পুরুষদের ক্রিকেটেও ফাঁকাই থাকে।

স্পন্সররা যে টাকা দেয় তাতেও নাকি নারীদের হিস্যা সামান্য। বিসিবি তাই চেষ্টা করলেও নারীদের বেতন বাড়াতে পারে না। অন্তত কর্মকর্তাদের যুক্তি মানলে এটাই সত্যি। এ তো গেল বেতনের কথা।

অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যে নারীদের বেলায় সমান সেটা বলা যাবে না। করোনাকালীন সময়ের কথাই ধরা যাক। পুরুষদের ফিট রাখার জন্য বিসিবির সেই সময় যে প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল, নারীদের বেলায় তার কানাকড়িও ছিল না।

বায়োবাবল কথাটা তখন খুব চালু ছিল। কিন্তু অনেক নারী ক্রিকেটারের কাছেই এটা কেবলই ছিল বায়বীয় এক ধারণা। পয়সা খরচ করে তাদের জন্য বাবল তৈরি করার কোনো গরজ বিসিবি দেখায়নি। 

বাংলাদেশের সৌভাগ্যই বলতে হবে। এতটা অনাদরে বেড়ে ওঠার পরও নারীদের ক্রিকেট পথ হারায়নি। প্রথমবারের মতো ভারতকে হারিয়ে দেওয়াই তো তার বড় প্রমাণ।

২০২২ খ্রিষ্টাব্দে সাফ ফুটবলে নারীদের সাফল্য অনেকেরই চোখ খুলে দিয়েছে। ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দিয়ে বিসিবি সেই সাফল্য উদযাপনের অংশ হয়েছে। ফুটবলের সাফল্যে আর্থিক পুরস্কার দেওয়াটা অবশ্যই তাদের বড় উদারতা। কিন্তু নারীদের সাফল্য উদযাপনে তাদের এই ধরনের উদারতা দেখিয়ে থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানে উদারতার চেয়ে দায়িত্বশীলতাই বেশি প্রত্যাশিত।

বেতন কাঠামো পরিবর্তন, পুরুষদের সমান ম্যাচ ফি, কিংবা ট্রেনিংয়ের বাড়তি সুযোগ সুবিধা এগুলো এখন সময়ের দাবি। ক্রিকেট এবং ফুটবলের যুগপৎ সাফল্যে নারীদের খেলাধুলার ব্যাপারে আমাদের সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

এখন বিসিবির মতো আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে বাকি কাজটা এগিয়ে নিতে। মারুফাদের মুস্তাফিজ হওয়াটা কেবল ক্রিকেট নয়, সমাজের স্বার্থেই জরুরি। ক্রিকেটের ঝকমকে আলোয় দাঁড়িয়ে তারা যে অন্ধকার দেখে সেইখান থেকে বিসিবিই পারে তাদের বের করে আনতে।  

আজাদ মজুমদার ।। যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ

সূত্র : ঢাকা পোস্ট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম - dainik shiksha ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান - dainik shiksha জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005591869354248