বাজেট নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের আকাঙ্খা

মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ |

উন্নত আর মধ্যম আয়ের দেশ যা-ই বলা হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের মহাসড়কে দারুণ অনগ্রসর ও করুণ পেশাজীবীর নাম ‘বেসরকারি শিক্ষক’। আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে ওইসব মানুষদের আকাঙ্খা ও অপেক্ষা যেমন বিক্ষিপ্ত তেমনি যার যার অবস্থান বিবেচনায় যৌক্তিক। তারা প্রধানতঃ কয়েক ভাগে বিভক্ত:

এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর ভাবনা, একযোগে শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণা। অথবা অন্তত বৈশাখি ভাতা, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ঘোষণা থাকবে এই বাজেটে।

মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজের নন-এমপিও শিক্ষক এবং বিশেষত কলেজের অনার্স পর্যায়ের শিক্ষকদের স্বপ্ন-সাধ আসন্ন বাজেটে তাদের এমপিওভুক্তির কার্যকর ও নিঃশর্ত বাস্তবায়ন ঘটবে।

যে সব স্কুল কলেজ জাতীয়করণের প্রক্রিয়া সমপন্ন হয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের একমাত্র অপেক্ষা আসন্ন বাজেটে তাদের ভাগ্যাকাশে নতুন নক্ষত্রের উদয় ঘটবে। অথচ সাধারণ শিক্ষকদের কেউ জানেন না, আসন্ন বাজেটে তাদের জন্য কী থাকবে? এ কি কেবলই আশা ও অপেক্ষার জাল বোনা না? না কি মানুষ গড়ার কারিগর এসব অবহেলিত জনের আসন্ন ঈদুল ফিতর হবে বিবর্ণ ও নিরব অভিমানের? এখন এমন বাস্তবতায় সার্বজনীন একমাত্র প্রত্যাশা শিক্ষা জাতীয়করণ। অথচ অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের বছরে সরকারকে বিব্রত করা বা চাপে ফেলার জন্য শিক্ষা জাতীয়করণের চলমান তৎপরতা। কথাগুলো নিতান্তই খণ্ডিত ভাবনা। শিক্ষা জাতীয়করণের তৎপরতা এ পর্যায়ে পৌঁছেছে মূলত কয়েকটি কারণে: 

(১) পেশাগত চরম বঞ্চনা। একজন সাধারণ শিক্ষকের সামর্থ্য এখন এমন যে, কেউ আর তাদেরকে দৈনন্দিন ধার-কর্জও দিতে চায় না।
(২)২০১৫ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় বেতনস্কেলে বর্ণিত বৈশাখীভাতা ও ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি থেকে এমপিওভুক্তদেরকে বঞ্চিত করা।
(৩)খণ্ডিত জাতীয়করণের তৎপরতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত বহু প্রতিষ্ঠান বাদ যাওয়া।

আরো এমন অনেক কারণে এমপিওভুক্তদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলে উচ্চারিত হতে থাকে জাতীয়করণের আওয়াজ। শিক্ষক সমাজের ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে থাকে নানান সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগ ও প্রচার মাধ্যমের সুবাদে শিক্ষকদের দাবি ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। ক্রমে তা কর্মবিরতি, মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন আঙ্গিকে বিকশিত হয়। কখনো কখনো তৈরি হয় বাধা-নিষেধের আবর্ত। তবু মানুষ গড়ার নিপুণ-নিবর এ সব কুশিলবদের আকাঙ্খা অবদমিত হয়নি। কারণ, আমরা জানি, যুগে যুগে মানুষের অধিকারের আওয়াজ হারিয়ে যায়নি। 

শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার।আমাদের সংবিধানেও গণমুখী, বৈষম্যহীন ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেক শিক্ষা স্তরে সরকারি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, শিক্ষক রয়েছে। কিন্তু এক ও অভিন্ন শিক্ষা বিভাগ থেকে দেশের প্রাথমিক, এবতেদায়ি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, ক্যাডেট ও উচ্চ শিক্ষার সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো একই নিয়ম নীতি, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণীত হচ্ছে। অথচ আর্থিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে।বেসরকারি শিক্ষকরা এদের পাঠদান করছেন। অন্যদিকে গুটি কয়েক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে ব্যাপক সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
একই দেশে, একই সরকারের অধীনে একই শিক্ষা বিভাগে দু’রকম শিক্ষাব্যবস্থা কি স্বাভাবিক? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় তো এমনটা অপ্রত্যাশিত।অথচ এদিকে সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু কিছু পদক্ষেপের ফলে দেশের অনেকটা উন্নতিও হয়েছে সত্য। এরপরও বিভিন্ন স্তরে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য রয়েই গেছে।

০১. সরকারিরা বাড়িভাড়া মূলবেতনের ৪৫ শতাংশ বা বেশি পান, বেসরকারিরা এক হাজার টাকা পান পিয়ন থেকে প্রিন্সিপাল সবাই।
০২. সরকারিরা পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ভাতা পেলেও বেসরকারিরা পান ৫০০ টাকা। 
০৩. সরকারিরা উৎসবভাতা মূলবেতনের সমান ও বেসরকারিদের উৎসবভাতা মূল বেতনের ২৫শতাংশ শিক্ষকদের জন্যে ও কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ।
 ০৪. সরকারিদের ইনক্রিমেন্ট প্রতিবছর বেতনের সাথে যোগ হয়।বেসরকারিদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নেই।
০৫. সরকারিদের বদলি, পদোন্নতি, বিনোদন ভাতা আছে। বেসরকারিদের বদলি, পদোন্নতি, বিনোদন ভাতা নেই।

মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতোই ‘শিক্ষা’ মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি কল্যাণরাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। আমাদের সরকারও মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই, শিক্ষা জাতীয়করণ কোনা অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য প্রত্যাশা নয়।

অন্যদিকে যদি জানতে চাওয়া হয়
(ক) কোনো পেশায় কি সবাই একই হারে বাড়িভাড়া পায়?
(খ) কোনো পেশায় কি কেউ চারটি উৎসবে একটি উৎসবভাতা পায়?
(গ) কোনো পেশায় কি পদোন্নতি ও বদলী নেই?
(ঘ) কোনো পেশায় কি বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ও বৈশাখীভাতা দেওয়া হয় না?
(ঙ) কোনো পেশায় কি সরকারের রাজস্ব খাত থেকে জাতীয় বেতনস্কেল অনুযায়ী বেতনের পরিবর্তে ‘অনুদান’ সুবিধা দেওয়া হয়? 
উত্তর হলো, এমপিওভুক্ত নিরিহ বেসরকারি শিক্ষকগণই এমন গর্বিত পেশার মাধ্যমেই জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বেলে যাচ্ছেন। 

পরিশেষে আশা ও অপেক্ষায় রইলাম, মানুষগড়ার কারিগরদের আহাজারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরব থাকবেন না। মানুষের কষ্টের কান্না সবচেয়ে বেশি টের পান বলেই তিনি আন্তরিকভাবে মহান জাতীয় সংসদে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁর কথা হলো: এমপিওভুক্তি ও শিক্ষা জাতীয়করণে, নীতিমালার আলোকে আগামি বাজেটে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এতে আমরা প্রত্যাশার পদধ্বনী শুনতে পাচ্ছি। পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার মাদার অব হিউমিনিটি খেতাবধন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর  দিকে তাকিয়ে আছেন। কাজেই, সবার অপেক্ষা আসন্ন বাজেটেই ‘এক ঘোষণায় শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের ব্যবস্থা করবেন শিক্ষক দরদী বর্তমান সরকার। এতেই অভিন্ন সিলেবাসে পাঠদানকারী প্রায় শতভাগ বেসরকারি শিক্ষকের নানান বঞ্চনারও অবসান ঘটবে। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া গাজীপুর 
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060470104217529