বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস) জ্ঞানের উৎকর্ষে আলোকিত, ন্যায়ভিত্তিক, পরিবেশসম্মত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উদীপ্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ় প্রত্যয়ী। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য অন্যান্য সেক্টরের মতো বাপুসও নিজস্ব কর্মপরিসরে কর্তব্য-কাজ সম্পাদন করাকে তার দায় ও পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে। প্রত্যাশার অনুকূল স্বদেশ তথা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন রচনায় আমরা প্রভাবিত এবং প্রভাবকও বটে। বাপুস তার গবেষণালব্ধ ফল হিসেবে বিশ্বাস করে যে, এই অভিযাত্রায় সফল হতে হলে আপাতত চারটি পূর্বশর্ত পূরণ করা জরুরি। যাকে আমরা ‘4P নীতি’ বা ‘ফোর পি পলিসি’ বলতে পারি।
এগুলো হলো-প্রকাশক এবং বিক্রেতার স্বার্থরক্ষা করা, শিক্ষার্থী ও পাঠকের স্বার্থরক্ষা করা, বাংলাদেশের প্রকাশক এবং প্রকাশনার মানোন্নয়ন করা এবং স্টেকহোল্ডারদের তথা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রকাশনাশিল্পের উন্নতিসাধন করা।
এই কাজগুলোর বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রধান দায় অবশ্যই ‘বাপুস’-এর। কিন্তু তা একান্তই তার একার নয়। পাশাপাশি সহায়ক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সমিতি/দপ্তরের নেতৃবৃন্দকেও এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য সমিতি প্রতিষ্ঠান সংস্থার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি'কেও একই রকম সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে হবে। কেন না শিক্ষার্থী ও পাঠকবান্ধব একটি বিশ্বমানের প্রকাশনাশিল্প গড়ে তোলা শুধুমাত্র সময়ের দাবি নয়, রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে একান্ত প্রয়োজন। আর একটি সমন্বিত টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে এই কর্মযজ্ঞের বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করা যতোটা সহজসাধ্য হয়ে উঠবে, তার অন্যথা ঘটলে কাজটির সমাধান ততোটাই কঠিন হয়ে উঠবে বলে বাপুস মনে করে।
প্রকাশক এবং বিক্রেতার স্বার্থরক্ষা করা
স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে শরিক হতে বাপুস-এর যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়ন করতে হলে চলতি প্রতিযোগিতামূলক সমাজে প্রধান দুই চালিকাশক্তি হিসাবে প্রকাশক এবং বিক্রেতাদের টিকে থাকার কোনো বিকল্প নেই। কেনোনা এই টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে পাঠ্য, পাঠসহায়ক, সৃজনশীল এবং মননশীল বইয়ের প্রকাশনা এবং তার বিকিকিনির বাজারব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে সচল রাখা। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সমস্যাগ্রস্ত প্রকাশক ও বিক্রেতাদেরকে বাপুস-এর সদস্যকল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে । যা মূলত প্রত্যক্ষ প্রভাবক হিসাবে লক্ষ্যস্থিত শিক্ষার্থী এবং পাঠকদেরকে উপকৃত করবে।
শিক্ষার্থী ও পাঠকের স্বার্থরক্ষা করা
খুব সাদামাটাভাবে মোটাদাগে এই রকমের একটা মূল্যায়ন লক্ষ্য করা যায় যে, বাপুস কেবল তার সদস্যদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারটিকেই একপাক্ষিকভাবে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি কি তাই? প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ‘বাপুস’ শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষার্থে বদ্ধপরিকর। এটা স্বীকৃত সত্য যে, স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে লাখ রাখ শিক্ষার্থীর মাঝে প্রধান শিক্ষা-উপকরণ হিসেবে ‘বই’ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ‘বাপুস’-এর অবদান অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য. বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পূর্ব পর্যন্ত ‘বাপুস’ অত্যন্ত সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণে নিরলসভাবে কার্যকর অবদান রেখেছে। বাপুস-এর অন্যতম প্রত্যক্ষ ও সম্পূরক উদ্দেশ্য হলো টার্গেট-পিউল হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক পাঠকের স্বার্থকে সুরক্ষা দেয়া। অতএব, এই সুরক্ষাকে নিশ্চিত করাই বাপুস-এর প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশের প্রকাশক ও প্রকাশনার মানোন্নয়ন করা স্বপ্নের স্মার্ট স্বদেশ বিনির্মাণে শরিক হয়ে, আলোকিত নাগরিক তৈরিতে বাপুস-এর প্রধান অবলম্বন হলো বাপুস-এর প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশের প্রকাশক ও প্রকাশনার মানোন্নয়ন করা
স্বপ্নের স্মার্ট স্বদেশ বিনির্মাণে শরিক হয়ে, আলোকিত নাগরিক তৈরিতে বাপুস-এর প্রধান অবলম্বন হলো যথাযথ বিষয়ভিত্তিক মানসম্মত পুস্তক প্রকাশ করা। কিন্তু মানসম্মত বই প্রকাশ করতে পারার পূর্বশর্ত হলো প্রকাশক এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশের মান বৃদ্ধি করা। সেটি করতে গেলে আমাদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিশ্লেষণপূর্বক মতবিনিময়ের পর নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে ‘বাপুস’ অত্যন্ত আবশ্যক বলে মনে করে:
১. সব প্রকাশকের গ্রন্থজ্ঞান কমপক্ষে একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকার ক্ষেত্রে কমবেশি ঘাটতি থাকতে পারে। এই বিষয়ে আলোচনা, সেমিনার, দক্ষতা বিনিময়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
২. তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আপদকালীন প্রণোদনা দেয়ার ব্যাপারটিও বিবেচনার দাবি রাখে। ৩. ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাবার নিয়মনীতির সহজীকরণ করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কেনোনা তাতে সংশ্লিষ্টদের পুঁজির ঘাটতি লাঘব হবে।
৪. প্রকাশনার কাঁচামালের বাজার মনিটরিং, নিয়ন্ত্রণ, সহযোগিতা ইত্যাদির নিশ্চয়তাবিধানে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা বাঞ্ছনীয়।
৫. সরকারি বই কেনার কর্মসূচিগুলোতে যাতে আরো বেশিসংখ্যক প্রকাশক বই বিক্রয়ের সুযোগ পান সে বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৬. প্রকাশনা খাতটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের কর অবকাশ বা সীমিত কর প্রদানের বিষয়টিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। স্টেকহোল্ডার্সের অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রকাশনাশিল্পের উন্নতিসাধন করা
বাংলাদেশে প্রকাশনাজগৎ পরিপূর্ণভাবে একটি ‘প্রকাশনাশিল্প’ হয়ে গড়ে উঠতে পেরেছে কি না, এই প্রশ্নকে চাইলেই বাতিল করে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেতো বটেই, তারও বহু আগথেকে একটি ব্যাপকসংখ্যক লোকবল প্রকাশনাজগতের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু জগৎটি কি এখন পর্যন্ত একটি উত্তীর্ণ ‘শিল্প’ হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছে? এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এইজন্য ভাবা দরকার যে, নানা অর্থনৈতিক শ্রেণির ব্যাপকসংখ্যক নাগরিকের রুটিরুজির বিষয়টির সঙ্গে থে জড়িত । তাদের জন্য অধিকতর সাফল্যজনক ভবিষ্যৎ রচনা করতে চাইলে, প্রকাশনা শিল্পের সার্বিক উন্নতি সাধন করার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
উল্লেখ্য, মুদ্রণশিল্প, বাঁধাইকারকরা এবং এর সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক, বিক্রয় প্রতিনিধিরা, সম্পাদক ও প্রুফরিডাররাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রকাশনাশিল্পের উন্নয়ন ও এর সার্বিক পরিবেশকে ইতিবাচক রাখাকে ‘বাপুস’ নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে।
লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি