বাবা বেসরকারি শিক্ষক৷ যে যেখানেই দেখে বাবাকে সালাম দেন৷ সন্তানকেও লোকেরা মাস্টারের ছেলে-মেয়ে বলে স্নেহের চোখে দেখেন৷ বাবার নামে সন্তানের কতই অহঙ্কার! তবে অন্যদের ছেলে-মেয়ের মত তারাও ঈদের স্বপ্ন পুরো বছর জুড়েই দেখতে থাকে৷ স্বপ্ন দেখে নতুন জামার৷ রমযান আসলে স্বপ্নটা আরো নিবিড় ও ঘনীভূত হয়৷ ওদিকে বাবার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা হচ্ছে সন্তানের চাওয়া পূর্ণ করতে না পারা৷ কিন্তু সন্তানদের এ স্বপ্ন পূরণ করা যায় কীভাবে? চার হাজার টাকা ঈদ বোনাসে কি দু'টি সন্তান ও স্ত্রীকে বর্তমান বাজারে নতুন পোশাক কিনে দেয়া যায়? শিক্ষক সারা বছর যা বেতন পান, তা থেকে কি ঈদ কেনা কাটার জন্য টাকা জমা রাখা যায়? সন্তানের চাওয়া মেটানো যে বড়ই তৃপ্তির! বড়ই আনন্দের! সে চাওয়া পূরণ করতে না পারলে বাবা যেন অসহায় এক নিস্তেজ প্রাণী৷ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে হয় তাকে৷
আমি শিক্ষক, আমি আমার শিক্ষার্থীদের বড়ই ভালোবাসি৷ তাদের কাছে আমি রাজা, ভালো বক্তা, আমি বন্ধু, আমি পিতা, আমি পথপ্রদর্শক, আমি... আরো কত কী! ছাত্ররা বর্তমানে শিক্ষকদের বন্ধুই মনে করে৷ তাতে একটি ভালো ফলও আছে৷ ছাত্রদের শিক্ষকভীতি কমে যায় ও শিখন শিখানো কার্যক্রম অতি সহজতর হয়৷ আমরাও ছাত্রদের আদরে ও স্নেহে বন্ধু ভেবেই পাঠদান করে থাকি৷ এটিই আধুনিকতার সহিত শিক্ষাদান৷
একদিন ঈদ আলোচনার কথার ছলে হঠাৎ দশম শ্রেণির এক ছাত্র জিজ্ঞাসা করল, ‘‘স্যার, আপনারা কত পার্সেন্ট ঈদ বোনাস পান?” কথাটি শুনেই ইতস্তত করতে লাগলাম। তারা জানলো কীভাবে? উত্তর কী দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাদের কাছে আমি মহান ব্যক্তি। ব্যাপারটা লজ্জাকর ব্যাপারই হয়ে দাঁড়াল। অস্ফুটে বললাম ২৫ শতাংশ। ছাত্রটি আবার জানতে চাইল, ‘কত টাকা আসবে, স্যার?’ বললাম সহকারী শিক্ষকদের ৪ হাজার টাকা, আর যার টাইম স্কেল পেয়েছেন তারা ৫ হাজার ৫০০ টাকা। শুনে সে খুব আস্তে করে বলল, ‘কাকে কাকে নতুন জামা দেবেন, স্যার?’
নিজেই ভাবতে লাগলাম, আর যেন কী প্রশ্ন জানি সে করে! ভাবছি, চার হাজার টাকার ঈদ বোনাস! ছাত্ররাও জেনে গেল? বর্তমান সমাজে অর্থের সাথে মানুষের মান সম্মানও নির্ভর করে৷ ভাবনাটা আবার ফিরে এলো- মেয়ে পাবে কী, আর ছেলেই বা পাবে কি? একজন পরিকল্পিত পরিবারে পিতা মাতাসহ ৬ জন সদস্য থাকার কথা এবং আমরা ৬ জনই। নিজে কিছু কেনার কথা তো কখনই ভাবি না; আগেও কখনো ভাবতাম না৷ আরো তো বাকি থাকে ৫ জন সদস্য। কাকে কী দেব!
আমার হিসাব একটু ভিন্ন। কারণ আমি একজন শিক্ষক৷ হাতে টাকা না থাকলে নিজকে মিতব্যয়ী ভাবতে পছন্দ করি। এক ছেলে, এক মেয়ে৷ আছে বৃদ্ধ পিতা মাতা৷ বাজারে এত কম টাকায় ছেলে-মেয়েদের দেয়ার মতো কোনো জামাই নেই। খাবার দাবার আয়োজনের কথাটা আপাতত না হয় না-ই ভাবলাম। স্কুল খোলার ভাব ধরে খরচ এড়াতে না হয় শ্বশুর বাড়ি ও বোনের বাড়ি বেড়ানোর কথাটা এড়িয়ে চলে এলাম। কিন্তু মেয়ে তো স্কুলে পড়ে, তাকে যে একটি নতুন ভালো জামা না কিনে দিলে সে বান্ধবীদের সঙ্গে প্রেস্টিজ বাঁচিয়ে ঈদের আনন্দটাই করতে পারবে না।
গত সপ্তাহে এক শিক্ষক বন্ধুর বাসায় ইফতারের দাওয়াতে গেলাম৷ দু'জনে আলাপের মাঝে তার স্ত্রী এগিয়ে এলো৷ জিদ করে আমাকেসহ শোনানোর জন্যই তিনি আমার বন্ধুকে বললেন, ‘এ বছর ঈদে আমাকে কী দেবে?’ উত্তর সোজাভাবেই হলো, ‘চার হাজার টাকার ঈদ বোনাস, কত টাকার শাড়ী নেবে?’ তার স্ত্রী বললো, ‘আমার কিছুই লাগবে না। মেয়েটিকে এবার একটু ভালো চাইয়া জামা কিনে দিও। মেয়ে হাইস্কুলে পড়ে তার প্রেস্টিজ আছে। বান্ধবীদের সাথে ওঠাবসা করতে হয়।”
গত সপ্তাহে একদিন শপিংয়ে গেলাম এ বছর জামা কাপড়ের দরদাম কেমন তা জানতে। বড় শপিং সেন্টারে গেলাম না। কারণ সেখানে আমি কখনোই যাই না। কোন ছাত্র কৌতুহল বশে জিজ্ঞাসা করলে বলে দেই, ‘বড় মার্কেটে আর ছোট মার্কেটে একই জামা বিক্রি হয়। বরং বড় মার্কেটে লাইটিং করে জামার দাম বেশি রাখে৷ অনর্থক বেশি দাম দেয়ার প্রয়োজন কী?’ নিজে যতই নিজেকে পন্ডিত ভাবি ছাত্ররা ঠিকই বোঝে।
গত বছরের ঘটনা৷ এক ভদ্র লোকের সাথে কোনো এক কাজে বন্ধুত্ব! চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল৷ হঠাৎ তিনি একদিন মজা করেই বললেন, ‘বাংলাদেশের সেরা কিপ্টা শিক্ষক। একবার একটা জামা কিনলে দশ বছর পার করে দেয়। ঈদেও একটা নতুন জামা বানান না।’
আমি চুপ করে মনটা খারাপ করাতে তিনি চালাকি করে কথাটি একটু ঘুরিয়ে বললেন, তবে বর্তমানের শিক্ষকরা আবার একটু মডার্ন। আমি আর কিছুই বললাম না। কারণ আমি বা আমরাই তাদের আলোচনার প্রধান চরিত্র।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, বড় গোবিন্দপুর এএমবি উচ্চ বিদ্যালয়, চান্দিনা, কুমিল্লা৷
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]