বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ, বিচারক স্বল্পতায় মামলা জট

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

৪০ লাখের বেশি মামলা ঝুলছে দেশের আদালতগুলোতে। ১৫ বছরের ব্যবধানে বিচারাধীন মামলার জট দ্বিগুণ হয়েছে। এর প্রধান কারণ বিচারকের স্বল্পতা। দেশে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারক একজন। এমন চিত্র উঠে এসেছে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে। বিচারক সংকটসহ বেশ কিছু কারণ তুলে ধরে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে ।

 মঙ্গলবার ( ২৯ আগস্ট) আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ৪৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, দেশের সংবিধান বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে থাকবে বলে ঘোষণা দিলেও কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘সোনার হরিণ’ হয়েই থাকে। দুঃখজনক হলেও এই বিভাগ কোনো সময়ই সরকারের কাছ থেকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ আদালতসহ জেলা আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৯ হাজার ৯২৮টি। হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৮ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৪। জেলা ও দায়রা জজসহ অধস্তন আদালতগুলোতে ২০০৮ সালে মামলা ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১২১টি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলা বেড়ে হয় ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টি। মামলাজট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের শুধু আস্থাই হারিয়ে যাবে না, বরং বিচার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।

বিচারকস্বল্পতাকে মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতার প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অতি নগণ্য। আপিল বিভাগে বিচারপতি আটজন এবং হাইকোর্টে বিচারপতি ৯০ জন। আপিল বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা ২ হাজার ৪৯১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা ৫ হাজার ৭৪১টি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বর্তমানে বিচারক প্রায় দুই হাজার। এর মধ্যে ডেপুটেশনে রয়েছেন আনুমানিক ২০০ জন। সে হিসাবে বিচারকপ্রতি মামলা ২ হাজার ৩৩টি।

জনসংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিচারক নিতান্তই কম। যুক্তরাজ্যে বিচারকপ্রতি জনসংখ্যা ৩ হাজার ১৮৬, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার, ভারতে ৪৭ হাজার ৬১৯ ও পাকিস্তানে প্রায় ৫০ হাজার।

দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অপ্রতুল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার কারণে অনেক আদালত ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে পরিচালিত হয়। তা ছাড়া যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজরা দেওয়ানি আপিল, রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন বিচারককে বিভিন্ন ধরনের একাধিক আদালতের মামলার বিচারকার্যে নিয়োজিত থাকতে হয়। অনেক আদালতের বিচারক এত বেশি ভারাক্রান্ত যে তিনি যদি শুধু স্বাক্ষরও করেন, তাতেও অনেক সময় ব্যয় হয়। লিস্টে থাকা প্রতিদিনের মামলা শুনানি করা প্রায়ই সম্ভব হয় না।

এতে বিচারপ্রার্থী জনগণকে হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানি থেকে উত্তরণের জন্য যেসব আদালতে অধিক মামলা বিচারাধীন, ওই সব আদালতের ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজন অনুপাতে আরও অতিরিক্ত আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে পদ সৃজন করে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ করা হলে মামলার জট কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে।

মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণ

প্রতিবেদনে বলা হয়, অপ্রতুল বিচারক, বিশেষায়িত আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা, ফলহীন ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের, জনবলের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, আদালতগুলোতে মামলার সুষম বণ্টনের অভাব, প্রশাসনিক শৈথিল্য, অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির অভাব, আইনজীবীদের আন্তরিকতার অভাব, দুর্বল মামলা ব্যবস্থাপনা, জমিজমা-সংক্রান্ত কাগজ সংরক্ষণের অভাব, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যবহারিক জটিলতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, ক্রমাগত শুনানি না হওয়া, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, নকল সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম, উচ্চ আদালতের নথি তলব হওয়া, সংশ্লিষ্ট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ইত্যাদি মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণ। এ ছাড়া দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সমন ও নোটিশ জারিতে বিলম্ব, বিবাদীর লিখিত জবাব দাখিলে অস্বাভাবিক বিলম্ব, বাদীপক্ষের পুনঃ পুনঃ আরজি সংশোধন, অন্তর্বর্তীকালীন দরখাস্ত দাখিলের প্রবণতা, দেওয়ানি আদালতে ছানি মামলার আধিক্য, পারিবারিক মামলায় আপসের অজুহাতে সময়ক্ষেপণসহ আটটি কারণ তুলে ধরা হয়।

এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। প্রতিবেদনে বেশ কিছু বাস্তবমুখী যৌক্তিক সুপারিশ আছে। সংসদীয় কমিটির পরবর্তী বৈঠকে প্রতিবেদনটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে - dainik shiksha চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ - dainik shiksha সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন - dainik shiksha রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? - dainik shiksha বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে - dainik shiksha ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি - dainik shiksha প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002777099609375