বিজ্ঞান শিক্ষার সীমাবদ্ধতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পৃথিবী ছিল অপার বিস্ময় ও রহস্যের স্থান, সেই পৃথিবীকে মানুষ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উদ্ভাবনীর কারণে আজ বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও বিনোদনসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সীমাহীন অগ্রগতি সাধিত হয়েছ। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে। বিজ্ঞানের সকল অবদান পর্যবেক্ষণ এবং উপভোগ করেও বিজ্ঞান শিক্ষায় ও বিজ্ঞানচর্চায় বিমুখতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সেই উপলব্ধি থেকেই মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘দৈনিক শিক্ষা’য় গত পর্বে লিখেছিলাম বিজ্ঞান কেন প্রয়োজন, আর আজকে বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নিয়ে দু’কলম লিখার দুঃসাহস করছি।

শিক্ষা-বিষয়ক তথ্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস (ব্যানবেইস ১৯৯০-২০১৮)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ; ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ২৭ দশমিক ১৯ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ১৬ দশমিক ৬০ শতাংশ; ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২২ দশমিক ৮৩ শতাংশ; ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ;  ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ; ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ; ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকে ৩১ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। উল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক-সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানশিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। মঞ্জুরি কমিশনের ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তা কমে হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ! 

আরও পড়ুন : বিজ্ঞান শিক্ষা কেন প্রয়োজন

মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রবণতা শীর্ষক শিরোনামে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) কর্তৃক ২০০৯ ও ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে দুটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ঐ গবেষণায় সম্মানিত প্রতিষ্ঠান প্রধান, শ্রেণি শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রশাসক, কারিকুলাম-বিশেষজ্ঞ ও পলিসি-প্রণেতাগণের মতামত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া পর্যবেক্ষণ, ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে : বিজ্ঞান শিক্ষা তুলনামূলকভাবে কঠিন, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য; উপযোগী টিচিং-লার্নিং উপকরণের স্বল্পতা; বিজ্ঞান শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বই ও উপকরণের অপর্যাপ্ততা; এসএসসি ও এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত কারিকুলাম ও সিলেবাস তুলনামূলকভাবে ব্যাপক; যোগ্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বিজ্ঞান শিক্ষকের অপ্রতুলতা; শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পারস্পরিক জবাবদিহিতার অভাব; মানসম্মত শিক্ষাদান পদ্ধতির অভাব;বেশিরভাগ বিজ্ঞান শিক্ষক আপডেটেড জ্ঞান বা পাঠপ্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যান না; প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় প্রত্যাশিত নম্বর না পাওয়ার আশঙ্কা; বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত দীর্ঘসময় ব্যবহারিকও তত্ত্বীয় ক্লাসে থাকতে হয়; অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হয়; বিজ্ঞানাগারে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অপর্যাপ্ততা; উচ্চশিক্ষা স্তরে বিজ্ঞানের ফ্যাকাল্টিগুলোতে আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় ভর্তি সুযোগ না থাকা; শিক্ষকরা শিক্ষাবর্ষে সিলেবাস শেষ করতে না পারায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়তে শিক্ষকদের শরণাপন্ন হতে হয়; আমাদের দেশে প্রায়ই পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চাকরি পাওয়া যায় না; বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ব্যাংকিং, ব্যবসা, রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে হয়, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অল্প শ্রম ও সময় দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে ডিগ্রি অর্জনকারী গ্র্যাজুয়েটদের চাকুরি পাওয়া অনেকক্ষেত্রে সহজ হয় ইত্যাদি।

একসময় প্রতিটি স্কুল-কলেজের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য রোমাঞ্চ অনুভব করত, কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জীববিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়ন শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেও পরবর্তীকালে ব্যবসা শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ কয়েক দশক আগেও এরকম প্রবণতা ছিল না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে উচ্চতর গণিত না নিয়ে অন্য বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে উচ্চতর গণিত ব্যতিরেকে বিজ্ঞান পড়া নিরর্থক। তাই তারা মানবিক বা ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয় বা কখনো ড্রপআউট হয়ে যায়। এটা খুবই দুঃখজনক। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চতর গণিতকে ঐচ্ছিক করা হয়েছিল, ফলে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অধিকাংশ বিজ্ঞান-পরীক্ষার্থীরা সাধারণ গণিতে মাত্র ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে এসএসসি পাস করে আসছে। এইচএসসিতেও গণিত ছাড়া বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে কেউ কেউ উত্তীর্ণ হলেও এরা উচ্চশিক্ষায় যেতে না পেরে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা বা ভূগোল বিষয় নিয়ে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করছে। 

দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে, গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে নিয়োগ দাতা কর্তৃপক্ষ জানেন না বা বুঝতে চেষ্টা করেন না পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত ছাড়াও বিএসসি পাস করা যায়! ইতোমধ্যে অসংখ্য বিজ্ঞান শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন উচ্চতর গণিত না শিখে। ফলে গণিত সম্পর্কে এই শিক্ষকদের ভালো ধারণা নেই। তারা বাজার থেকে নোট বই কিনে নেন। নোটে ভুল-শুদ্ধ যেভাবে আছে, সেভাবে অঙ্ক শিখেন এবং মুখস্থ করে অঙ্ক শেখান, শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি না থাকলেও হোমিওপ্যাথি বিএসসি গণিত-শিক্ষকদের গণিত ভীতি রয়েছে। শিক্ষকের নিয়মে অঙ্ক না কষলে শিক্ষক অঙ্ক কেটে শূন্য দিয়ে দেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের এক জরিপে দেখা গিয়েছে ৪৫০০ গণিত-শিক্ষকের মধ্যে ৯০ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাজীবনে মাত্র ১০০ নম্বরের অঙ্ক শিখে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেছেন। একজন শিক্ষক ৩০ থেকে ৪০ বছর শিক্ষকতা পেশায় থাকবেন। অথচ পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়ে ৪০ বছর ভুল শিখাবেন, সেটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে ঐ শিক্ষকের ছাত্ররাও যখন আবার শিক্ষক হয়ে আসবেন তখন দেশের শিক্ষার মান কী হতে পারে,আশা করি পাঠকরাই তা বুঝে নিবেন। 

ব্যানবেইস তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের বেশ কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ আছে, যেখানে উপযোগী বিজ্ঞানাগার নেই। অথচ বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান দুটিই অপরিহার্য। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানাগার আছে সেগুলোতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি আছে এবং কতটা ব্যবহৃত হয় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির বিজ্ঞান ইউনিট একটি জরিপ চালিয়ে যে তথ্য পেয়েছেন তা হলো- আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেখানে বিজ্ঞানাগার আছে বা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে সেগুলোও খুব একটা ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক  যন্ত্রপাতি আছে শিক্ষকরা নিজেরাই সেগুলোর ব্যবহার জানেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা যায় যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় ক্লাস নিয়মিত তদারকি করবে এবং যেখানে বিজ্ঞানাগার নাই সেখানে বিজ্ঞানাগার তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া আধুনিক সভ্যতা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ বিজ্ঞান বিভাগগুলোতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এই আধুনিক যুগেও বিজ্ঞানচর্চা আমাদের কাছে অনেকটা অবহেলিত। তার প্রমাণ হলো-দেশে এত মোবাইল সেট ব্যবহৃত হচ্ছে অথচ মোবাইলসেট তৈরির একটি কারখানা এদেশে নেই। আমাদের ব্র্যান্ড দোয়েল ল্যাপটপ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই।

এক সাক্ষাৎকারে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, তথাকথিত বিএসসি শিক্ষকদের ভাবতাম বিজ্ঞানের সাগর। এখন মনে হচ্ছে, কয়েকটি প্রজন্মকেই নষ্ট করেছি। বিজ্ঞান গবেষণাগার, বিজ্ঞানের শিক্ষক ইত্যাদি না দিলে বিজ্ঞান শিক্ষার মান বাড়বে না এবং শিক্ষার্থী কমে আসবেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা বিজ্ঞান পড়ছে তারা নির্ভুল পড়ছে কিনা এবং তাদের গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে কি না? অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে খরচ একটু বেশি, এটা সত্য। গ্রামের অধিকাংশ অভিভাকদের বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা কম। গ্রামের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান ল্যাব ও শিক্ষকের সংকট রয়েছে। অতীতে মনোবিজ্ঞান বা এ ধরনের বিষয় নিয়ে যারা বিএসসি পাস করে স্কুলে যোগদান করেছেন, তারা যখন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন পড়ান, তখন যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯ হাজার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৪ হাজার ৫০০টি কলেজ এবং ৪৬টি পাবলিক ও ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষা একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করতে হবে। প্রকৃতি,পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ভুল ছবি সংযোজন করে পাঠ্যপুস্তুকসমূহ সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয় করে শিক্ষার্থীদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া দরকার। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের জন্যে পর্যবেক্ষণ, নানারকম চিত্র, ভিডিও প্রদর্শন এবং নিজেদের দ্বারা সহজেই করা সম্ভব এমন সব সহজলভ্য উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিশিক্ষা এবং মানবিক শিক্ষার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের একটি যে অন্যটির পরিপূরক, এই বিষয়টি মাথায় রেখে একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা আবশ্যক। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত না হলে জাতি হিসেবে আমরা সামনে এগুতে পারব না। 

বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে হলে নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে : গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারসহ উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতার আয়োজন; বিজয়ী শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা; প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ের যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব রয়েছে সেখানে শ্রেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সেশনসমূহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার; আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিক্ষাদানের কৌশল ও দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা; স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানাগার আধুনিকায়ন; বিজ্ঞানাগারে উপযোগী উপকরণ সরবরাহ; বর্তমান প্রজন্মের তরুণ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান মনস্ক করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত পরিকল্পনা; বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক করা; মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া; চাকরির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিষয় ও বিভাগ খোলা; ভালো শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন ও মর্যাদা দেয়া; পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সমগ্র দেশব্যাপী ‘বিজ্ঞান সচেতনতা’ আন্দোলন গড়ে তোলা ইত্যাদি।

বিজ্ঞানে পাস করা এসব মেধাবী তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দেশেই করতে হবে; ফার্মাসিউটিক্যালস, ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও পোশাক শিল্পে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে; শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও গবেষণার ক্ষেত্র বাড়ানো এবং বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনটি ধাপে এ কাজগুলো করা যেতে পারে : (ক) প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে অনুপ্রেরণা দেয়া (খ) মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নসংশ্লিষ্ট বরাদ্দ বাড়ানো (গ) পড়ালেখা শেষ হওয়ার পরপরই তাদেরকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান মনস্ক করে এমনভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন যেন প্রতিভা-বিকাশ, জ্ঞানসাধনা এবং সৃজনশীলতায় তারা আন্তজার্তিক মান অর্জন করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে আনন্দের সঙ্গে বিজ্ঞান পড়ানো ও গবেষণা কর্মসম্পাদনের কৌশল অবলম্বন করা হয়, যা আমাদের দেশে বেশি বেশি প্রয়োজন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের চর্চা, অর্থ উপার্জন এবং সর্বোপরি শিক্ষাজীবনেই দেশগঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করার সুযোগ পাবে। আগামীতে বিজ্ঞান শিক্ষার ভীতি অনেক কমে যাবে। 

এটা ধ্রুব সত্য যে ‘Mathmatics is the Mother of Science’। বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে গণিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় গণিত শিক্ষায় জোর দেয়া; গণিত বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের গণিতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া; ব্যবহারিক ক্লাস ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা অর্থহীন বলে নিয়মিত ব্যবহারিক ক্লাসের ব্যবস্থা করা; ব্যবহারিক পরীক্ষার যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা; শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞান এবং গণিতকে আকর্ষণীয় করার জন্যে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি জাতীয় পর্যায়েও বাৎসরিক বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা; সকল শিক্ষার্থীকে কম্পিউটার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া; বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের সঙ্গে কম্পিউটার বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া; তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহসৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাঝে সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলা; গবেষণার ফলাফল গবেষণা জার্নাল প্রকাশও সেগুলো সকল গবেষকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা; গবেষণার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য নিয়মিতভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা; বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলামসহ কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ খোলা; বিজ্ঞান সিলেবাস অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী করা, প্রজেক্ট বা গবেষণাধর্মী এসাইনমেন্টভিত্তিক শিক্ষাদান পদ্ধতি শুরু করা, মোটিভেশন প্রোগ্রামের আয়োজন করা, তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে একটি তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি।

বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ভালো বিজ্ঞান শিক্ষক, শ্রম বাজারে দক্ষ জনসম্পদ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে নেতৃত্ব দানের জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন লোকের অভাব দেখা দিতে পারে। সুতরাং এ দেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় অধিক পরিমাণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে আরো গতিশীল করা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। 

লেখক : প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029981136322021