‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’- শামসুর রাহমান (বন্দী শিবির থেকে)
১.
আবার এসেছে ১৬ ডিসেম্বর। এবারের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫১তম বিজয় দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলে। বুক ভরা আশা নিয়ে এ দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে। শুরু হয় মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ। যার চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই গৌরবোজ্জ্বল দিনটিই বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই বিশেষ দিনটিতে ২৬ মার্চ সূচিত মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এক সাগর রক্ত, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের
২.
‘স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা কতটা বাস্তবায়িত’ প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন ভাষা সংগ্রামী, গবেষক আহমদ রফিক। তিনি লিখছেন, ‘উপনিবেশবাদী বা প্রচ্ছন্ন উপনিবেশবাদী শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিসংগ্রাম তাবৎ বিশ্বের এক বাস্তব ঘটনা। আর ঘটনাগুলোর প্রকাশ জাতি চেতনার টানে, জাতিসত্তার স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। স্বাধীনতা এমন একটি জাদুকরী শক্তি, যার জন্য সংগ্রামী চেতনার মানুষ অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে তারুণ্য। এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার দলিত দেশগুলোর মুক্তিসংগ্রামের কাহিনী এমন ইতিহাসচিত্রই তুলে ধরে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদই সংগ্রামের প্রধান নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
৩.
ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের এই মাসটিকে আমরা বড় আবেগে আনন্দ ও বেদনা নিয়ে উদযাপন করি। আর বিজয়ের মাসটিকে স্মরণ করে রাখার জন্য জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়। এটি দেশ এবং জাতির জন্য গৌরবের দিন। আনন্দ বিজয়ে, বেদনা লাখো শহীদের আত্মদান আর রক্তের স্রোতের কারণে। আর তাই জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বিজয় হলো স্বাধীনতা অর্জন। এ অর্জন আমাদের অহঙ্কার। এ বিজয় আমাদের সীমাহীন গৌরবের। রক্ত-কান্না-লাশ-সম্ভ্রমক্ষয়ী ৯ মাস যুদ্ধে বাঙালী অর্জন করে- স্বাধীন-সূর্য। এভাবেই ’৫২ থেকে ’৭১ পর্যন্ত নানা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ উদিত হয়। কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ কতটা সর্বজনীন মানবিক মুক্তির সোনার বাংলাদেশ হতে পেরেছে সেই প্রশ্নটা আমাদের ভাবনায় চলেই আসে। ভেবে দেখার চেষ্টা করি স্বাধীন বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটা অগ্রসর হয়েছে। হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি, একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সার্বিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কতটা ফারাক রয়েছে, নাকি আদৌ কোন ফারাক নেই! দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন কতটা ঘটেছে এ দেশের সাধারণ মানুষের? জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত তাদের একমুঠো ভাত যোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। অপরদিকে, সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত আছে, থাকে।
৪.
আরো অনেকের মতোন আমার কাছেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে দারিদ্র্যমুক্তি, সেটা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নয়, মানসিকও বটে। তথনই চলে আসে রাজনীতির কথা, সংস্কৃতি-কৃষ্টির কথা, সুরুচির চেতনা বিষয়টিও দারুণ নাড়া দেয় আমার মনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, মনের দারিদ্র্যতা দূর করতে না পারলে মানসিক অর্থনৈতিক দৈন্যতা কখনো ঘুচবে না। আর এক্ষেত্রে সকল অসুখের সবচেয়ে ভালো পথ্য সুশিক্ষা, মানসম্পন্ন শিক্ষা সুনিশ্চিত করার বিষয়টিকেও এড়ানো দায়। আমাদের বহুমাত্রিক মানবজীবনের সংকটও বহুমাত্রিক। সেই বৈচিত্র্যময় মানব সমাজে মুক্তচিন্তা ছাড়া, মুক্তমন ছাড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মানবিক ব্যবহার ছাড়া, অন্ধ বিশ্বাসী মনের মানুষকে নিয়ে কতটুকু সুস্থ সমাজ বির্নিমাণ সম্ভব সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই থেকে যায়। আর তাই একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেই হিসেবী প্রশ্নটি স্বাভাবিক কারণেই জাগে অনেকের মনে।
৫.
আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলকথাই হচ্ছে, রাজনৈতিক মুক্তির পর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। অর্থাৎ বাংলাদেশ কেবল উন্নত হবে না; সেই উন্নয়ন হতে হবে সমতাভিত্তিক। সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে নীতিগত ও ব্যবহারিক কাজ করে যাবে রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাষ্ট্রের হৃদয়ে ধারণ করেই দারিদ্র্য নির্মূল করা। আর দারিদ্র্যমুক্তির পথে এগিয়ে চলার মূল ভিত্তিভূমি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত উন্নয়ন ও বিকাশ। আর সেই বিকাশ ও উন্নয়ন হতে হবে মানবকেন্দ্রিক। আরও ভেঙে বললে সাধারণ মানুষকেন্দ্রিক। কারণ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এদেশের আপামর জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। এক বক্তৃতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে যেমনটি বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যত রক্ত দিয়েছে, যত ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাংলাদেশের যতটুকু সম্ভাবনা ছিল, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ, দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতার অভাব আর দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন। তবে নানা সমস্যা থাকার পরও এর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসাধারণ।’
৬.
স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের প্রাণে গর্ব ও গৌরবের বাঁশি বাজায়। কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গত কয়েক বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু মানব মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে কতটা? অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক আবহ, আইনি সুরক্ষা। সেই সুযোগ গ্রহণে এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন স্থিতিশীলতা, শান্তিপূর্ণ ও সহায়ক পরিবেশ-পরিস্থিতি। এ ছাড়া জনসাধারণ তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশীদারিত্বের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, সেটাকেও ক্ষমতাসীনদের বিবেচনায় আনা ।জনসাধারণের জন্য মানবিক সব অধিকার নিশ্চিত করতে আরও দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়া জরুরি। কেবল দারিদ্র্য নির্মূলের পথ ধরে সব ধরনের দারিদ্র্য নির্মূল সম্ভব কি না ভেবে দেখতে হবে।
৭.
চলমান অর্থনীতির মানবকেন্দ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্রের সুফল সবার মাঝে নিশ্চিত করার সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি নয় কী ? আর সবার কল্যাণ সাধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। বস্তুত আমাদের সংবিধানেই এসবের পথনির্দেশ রয়েছে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্র। দুই দফা সামরিক শাসনের সময় সংবিধানের এসব মূলনীতি বিকৃত করা হয়েছিল বা সরকারের কর্মকাণ্ডে এগুলোর প্রতিফলন থাকত না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে নীতিগতভাবে বাংলাদেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় অনেকখানি ফিরে যেতে পেরেছে বলেই দৃশ্যমান হয়।
৮.
ভাষা সংগ্রামী, গবেষক আহমদ রফিকের ভাষায়, ‘একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক সর্বজনীন স্বার্থের চেতনা ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেরণা, যা রাজাকারবাদে সব শ্রেণীর জনচেতনা স্পর্শ করেছে। 'সোনার বাংলা'র স্বপ্ন নানাভাবে নানা শ্রেণীর মানুষের মন জয় করেছে। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে তাদের বাধেনি। হয়তো মনের গভীরে এমন উপলব্ধি বড় হয়ে উঠেছে। কবির ভাষায় বলা চলে- 'আত্মদানের উৎসে জানি উজ্জীবনের আশা।' আত্মদান ঘটেছে; কিন্তু উজ্জীবন সবার জন্য হয়ে ওঠেনি, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাজনীতি ও শাসননীতি সাধারণ মানুষকে এমন ধারণাই দিয়েছে যে লড়াইটা সর্বজনীন হওয়া সত্তে¡ও স্বাধীনতা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর হাতেই ধরা রয়েছে। তা সে শ্রেণী জাতীয়তাবাদী চেতনার যে ধারার হোক। তার চেয়ে বড় বিস্ময় স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-রাজাকার শক্তি দেশে জেঁকে বসেছে- শাসন-প্রশাসন, সামরিক-বেসামরিক, পেশাজীবী ও পুঁজিপতি শ্রেণীতে। এর পেছনেও রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির বিভ্রান্তিকর অবদান। রয়েছে আদর্শগত দৃঢ়তার অভাব। প্রায় চল্লিশ বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক অপরাধীদের বিচার শুরু হলেও এর মধ্যেই বিরোধীপক্ষ বেশ শক্তিমান হয়ে সব বানচাল করতে দাঁড়িয়ে গেছে। একাত্তরের ধারায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটছে, শ্লোগান উঠছে- 'ইসলাম বিপন্ন'। নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে এবং অনুরূপ শাসক শ্রেণীর উপস্থিতিতে এ জাতীয় শ্লোগান উন্মাদের পক্ষে শোভা পায়। তবু এটাই বাস্তবতা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও এলিট শিক্ষিতদের একাংশ এ উন্মাদনায় মদদ দিয়ে চলেছে। উদ্দেশ্য, সেই চিরাচরিত ক্ষমতা দখল। জনগণও বিভ্রান্ত ও দ্বিভাজিত। এটাও যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নৈরাজ্যের উত্তরাধিকার বলে মেনে নিতে হয়।’
৯.
আমরা দেখি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয়ের এক বছরেরও কম সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতিরা সদ্যজাত রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তা ছিল অনন্যসাধারণ এক রাষ্ট্রীয় দলিল। এই সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল- ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে পেছনের সারির একটি দেশ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যদিও বাঙালী জাতীয়তাবাদ চরিত্রগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, তারপরও রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক রাখার জন্য আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘৭২-এর সংবিধানে।
১০.
আমাদের সংবিধানের ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা জানতে পারি, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ‘৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল- যা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে কোন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব হয়নি। এই সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার ও জঙ্গী মৌলবাদের জেহাদী উন্মাদনা দেখতে হতো না বলেই মনে করা হয়। ’৭২ সালের সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পর এটি দুই ধরনের সমালোচনা শিকার হয়। এক পক্ষ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, যারা ইসলামকে মনে করে পরিপূর্ণ জীবনবিধান যা রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছু তাদের ব্যাখ্যা ও বিধান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করবে। অপরপক্ষ হচ্ছে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা, যারা পশ্চিমের প্রভাবে ধর্মকে ব্যক্তি ও সমাজজীবন থেকে নির্বাসনের পক্ষে। তাদের বক্তব্য ছিল ‘সেক্যুলারিজম’-এর প্রকৃত বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নয়, ‘ইহজাগতিকতা’। অপরদিকে মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে আক্রমণ করেছে এই বলে যে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে নাস্তিকতা, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে মানুষের ধর্মপালন ও প্রচারের স্বাধীনতা থাকবে না। মৌলবাদী নয়, এমন দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা ছিল-’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ঢুকিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মের প্রতি অনুরাগের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। শতকরা ৮৫% মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখি, ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী যাঁরা ‘৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তাঁরা ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। যে কারণে ইংরেজি সেক্যুলারিজমের বাংলা তাঁরা ‘ইহজাগতিকতা’ করেননি, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার বার তাঁদের বলতে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়।’
১১.
এ বিষয়ে গবেষকদের মত, ‘বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারণা পশ্চিমের চেয়ে বহুলাংশে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশে এবং ভারতেও সেক্যুলারিজম বলতে বোঝায় রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছিন্নতা, ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নয়।’ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। … আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। অতীতে আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে- আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)
১২.
বিগত ৪৯ বছরের ইতিহাসের নানা বাঁকে খুঁজে পাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। সেটা মানুষের বিশ্বাসের, আবেগের বিষয় ধর্মকে হাতিয়ার করে, যেমনটা এর আগেও দেখা গেছে। কারণ, ধর্ম ভয়াবহ রকম স্পর্শকাতর বিষয়, যা জনগণকে অন্ধ ও উন্মাদ করে তুলতে পারে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি আখের গোছানোর নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাধাগ্রস্থ হচ্ছে মানব উন্নয়ন, বিঘ্নিত হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিকাশ। ফলে ইহজাগতিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ভাবমুর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এর প্রতিরোধে চাই প্রবল জনমত, সুশিক্ষা আর সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ। মানুষের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই পারে সকল সংকট দূর করতে। এই সব বিবেচনা করেই তরুণ প্রজন্মকে জাগ্রত করতে দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, কলকারখানা ঘুরে ঘুরে একাত্তরের চেতনা ও মূল্যবোধ নির্মাণে সক্রিয় হতে হবে। একাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ-পরবর্তী অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা এবং নানা অক্ষমতার কারণে আমরা যেভাবে নষ্ট রাজনীতি ও লুটেরা সম্প্রদায়ের কাছে পরাভূত হয়েছি, তেমন করেনবীন প্রজন্ম পরাভূত হবে না সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, অনির্বাণ মূল্যবোধ, মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার এটাই সময়। ময়ূরপুচ্ছধারী কাক এবং মিষ্টি কথার নষ্ট ফেরিওয়ালা থেকে সাবধান। তাই আসুন পরস্পরকে ভালোবাসি নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে। এটাই হোক বিজয় দিবসের একান্ত শপথ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা