বিত্তবানের সন্তানেরা কেন জঙ্গি দলে

আহমেদ জায়িফ |

d9586711ad091e9a572fb8c8ecaac15f-27গুলশানে হলি আর্টিজান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ও সর্বশেষ ঢাকার কল্যাণপুরের ঘটনায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যেও সাতজন রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মাদ্রাসাপড়ুয়া থেকে শুরু করে শহুরে উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পর্যন্ত কেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন, তা এখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মনস্তত্ত্ববিদেরা বলছেন, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম শিক্ষিত তরুণদের দলে ভেড়ানোর কৌশল নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কিছুটা সফল হয়েছে। এখন এটা মোকাবিলার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলা, মাদারীপুরের কলেজশিক্ষককে হত্যাচেষ্টায় জড়িত এবং সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভোরে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছেন ১৬ জন জঙ্গি। হলি আর্টিজানের ঘটনা বাদে বাকি তিনটি ঘটনায় একজন করে সন্দেহভাজন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

নিহত ও গ্রেপ্তার হওয়া এই ১৯ জঙ্গির মধ্যে সাতজন ইংরেজি মাধ্যম বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাঁদের মধ্যে চারজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের, একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের, একজন মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। একজন স্কলাস্টিকা থেকে ও লেভেল পাস করা। বাকিরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁদের মধ্যে চারজন কলেজছাত্র ও ছয়জন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। একজন পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। একজনের লাশ এখনো শনাক্ত হয়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০১২-১৩ সাল থেকে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, নিম্নবিত্ত ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরাই শুধু জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, সবাই যখন এমনটা ধরে নিয়েছে; জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তখন তাদের লক্ষ্যবস্তুতে নিয়েছে শিক্ষিত তরুণদের। কারণ, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার প্রসার এবং ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ গঠন করার তাদের যে লক্ষ্য, সে জন্য শিক্ষিত তরুণদেরই তাদের প্রয়োজন বেশি। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যাঁরা সিরিয়ায় গেছেন, তাঁদের বড় অংশই উচ্চশিক্ষিত।’

বিত্তবান পরিবারের শিক্ষিত তরুণদের জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টি আগেও বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে। ২০০১ সালে এ দেশে হিযবুত তাহ্রীরের তৎপরতা শুরুর পর থেকেই বিষয়টি ক্রমে আলোচনায় আসতে থাকে। বিত্তবান পরিবারের সন্তান ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কেন্দ্র করেই হিযবুত তাহ্রীর (বর্তমানে নিষিদ্ধ) কার্যক্রম শুরু করে। তাদের সদস্যদের বড় অংশই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা।

১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর এই বিষয়টি সারা দেশের মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এটা সর্বত্র আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলশানের ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে তিনজনই ছিলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। এর মধ্যে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ স্কলাস্টিকা থেকে এ লেভেল শেষ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, স্কলাস্টিকা থেকে ও লেভেল পাস করেছিলেন মীর সামেহ মোবাশ্বের। নিবরাস ইসলাম ঢাকার টার্কিশ হোপ স্কুল থেকে পাস করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েছেন। তাঁদের সবার পরিবারই অবস্থাপন্ন এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

হলি আর্টিজানের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত মঙ্গলবার ভোরে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের হামলায় নিহত জঙ্গিদের পরিচয় এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সমাজের সচেতন মানুষদের আবার বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এখানে নিহত নয়জনের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত আটজনের পরিচয় জানা গেছে। একজন আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

পরিচয় পাওয়া নিহত আটজনের মধ্যে শেহজাদ রউফ ওরফে অর্ক মার্কিন নাগরিক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর ছাত্র ছিলেন। তাজ-উল-হক রাশিক একাডেমিয়া থেকে ও লেভেল ও পরে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে এ লেভেল পাস করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগ থেকে পাস করেন। নিহত আকিফুজ্জামান টার্কিশ হোপ স্কুলে পড়াশোনা শেষে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে একজন কলেজে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র, একজন উচ্চমাধ্যমিক পাস এবং দুজন মাদ্রাসায় ও একজন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।

এর আগে শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠের পাশে পুলিশের ওপর হামলাকারী নিহত জঙ্গি আবির রহমান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল (বিআইটি) থেকে এ লেভেল পাস করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক হত্যাচেষ্টার ঘটনায় প্রথমে আটক ও পরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত গোলাম সাইফুল্লাহ (ফাহিম) উত্তরার একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন।

সচ্ছল পরিবারের সন্তান এবং অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এসব ছাত্ররা কেন এ পথে গেল? এ বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দারিদ্র্যের কারণে বা বিশেষ একটি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়—এই ধারণা সঠিক নয়। যাঁরা জঙ্গিবাদের আকৃষ্ট হচ্ছেন, তাঁরা অর্থ বা জাগতিক কোনো কারণে ওই পথে যাচ্ছেন, এমনটা নয়। তরুণদের প্রথমে ধর্মের প্রতি অনুরক্ত করা হয় এবং পরে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সামাজিক অবস্থান এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না।

অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, এসব তরুণকে ফিরিয়ে আনতে হলে ধর্মেরই সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁদের চক্র ভেঙে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিবারকে সচেতন হবে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে জঙ্গিবিরোধী মানসিকতা গড়তে হবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024580955505371