দর্পণ যেমন মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখায় ঠিক তেমনি মানুষের ভেতরে বিদ্যমান অদৃশ্য এক সত্তা যা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। মানুষের ভেতরের সেই সত্তার নাম হলো ‘বিবেক’। মানুষের মৌলিক মানবীয় প্রাণশক্তিই হলো বিবেক, যা একজন মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে। প্রতিটি মানুষই বিবেকসম্পন্ন তবে কেউ সেটার পরিচর্যা করে আবার কেউ অবহেলা করে অযত্নে ফেলে রাখে।
বিবেকের পরিচর্যার মাধ্যমে মানুষ সত্যিকারের মানুষে পরিণত হয়, যত্নের অভাবে বিবেক আবার পচে মরে। মানুষের বিবেক যখন পচে যায় তখন সে পশু থেকেও নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয়। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
বলা হয়ে থাকে, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত মানুষের বিবেক’। কারণ মানুষ যখন নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কাজ করে বিবেক তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আক্ষেপের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কোনো ভুল বা অন্যায় করে ফেললে তখনই মানুষ অনুতপ্ত হয় যখন তার বিবেক তাকে অনুভব করায়। প্রতিটি মানুষই বিবেকসম্পন্ন কিন্তু যখন ছোটো ছোটো অন্যায়কে অন্যায় মনে করা না হয় তখনই তা ব্যাকটেরিয়া হিসেবে বিবেকে বাসা বাঁধতে শুরু করে।
ফলে ধীরে ধীরে বিবেকে পচন ধরতে শুরু করে। বর্তমানে সুস্থ সতেজ বিবেক অপেক্ষা পচা বিবেকের প্রতুলতাই লক্ষণীয়। মানুষের বিবেকের পচন এবং সমাজের পচন পরস্পর সমানুপাতিক। চার দিকের এত এত অসঙ্গতি, হিংসা-বিদ্বেষ, দৃশ্যমান অন্যায় অপকর্মের মূল হলো সুস্থ বিবেক অপেক্ষা পচা বিবেকের আধিক্য।
ভ্রাতৃত্ববোধ, ধৈর্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান, পরশ্রীমুখরতা বিলুপ্ত হতে চলেছে। সন্তানের হাতে বাবার খুন, ভাইয়ের হাতে অপর ভাই খুন, ছাত্রের দ্বারা অপর ছাত্রবন্ধু হত্যা, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছিত, শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণ এছাড়া আরো অসংখ্য অঘটন ঘটছে প্রতিনিয়তই। বিবেক পচে গেলে মানুষ তখন যা খুশি করতে পারে। কোনো কিছুই তখন তার কাছে অসম্ভব থাকে না। ধরুন কোনো রকম লিখিত ডকুমেন্টস ছাড়াই আপনার কোনো বন্ধুকে একটা ব্যবসা শুরু করার জন্য মূলধন জোগান দিলেন লাভের ২০ শতাংশ আপনি পাবেন এই শর্তে, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই বন্ধু একসময় শিল্পপতি বনে গেল এবং আপনাকে অস্বীকার করল।
আবার বর্তমানে খাদ্যে বা ওষুধে ভেজাল মিশ্রিত করার ঘটনাও নিত্যদিনের সংবাদ। এক মাছ ব্যবসায়ী ফরমালিন যুক্ত মাছ বিক্রি করে কিন্তু নিজে খায় ফরমালিন মুক্ত মাছ। মাছ বিক্রি শেষে যে সবজি কিনে নিয়ে গেল, দেখা গেল তাতে ফরমালিন মেশানো! ফরমালিন যুক্ত করে মানুষকে ঠকিয়ে একটু বেশি লাভ করতে চেয়েছিল, উদ্দেশ্য একটাই একটু বেশি উপার্জন করে ভালো থাকবে।
আমরা সবাই নিজে ভালো থাকতে চাই, সেটা যে কোনো উপায়ে হোক না কেন। যে কারণে বিবেক কে উপেক্ষা করে দিনকে দিন মানুষের মুখোশে হায়েনায় রূপান্তর হয়ে যাচ্ছি। ফলে সমাজে ধরছে পচন, দিনশেষে না পারছি কেউ ভালো থাকতে।
মানুষের জীবন শুধু তার নিজের সংকুচিত একটা সীমার ভেতর যদি সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে হয়তো বিবেক নামক কিছু না থাকলেও কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষ পরিবার সমাজ ছাড়া চলতে পারে না। আমরা তখনই ভালো থাকতে পারব যখন আমাদের চারপাশ তথা আমাদের সমাজকে ভালো রাখতে পারবো।
যার জন্য প্রয়োজন বিবেকের পচন রোধ করে সঠিক পরিচর্যা। সবকিছু তুচ্ছ মনে করে একজন ‘ভালো মানুষ হব’ এটাই যদি মনে-প্রাণে ধারণ করা যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিবেকও সুস্থ সতেজ থাকবে। বিনিময়ে আমরা পাব সুস্থ-সুন্দর, বাসযোগ্য সমৃদ্ধ এক সমাজ।
লেখক: ইয়াছির আরাফাত,শিক্ষার্থী, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়