বিলেতে বাংলার দুর্দিন সামনে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ব্রিটেনকে অনেকে বলে ‘তৃতীয় বাংলা’—কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পর সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাভাষীর বাস এখানেই। লন্ডনের মতো শহরে প্রতিবছর মাসব্যাপী বাংলা নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বইমেলা, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, বর্ষাবরণ, পহেলা ফাল্গুন—হেন উৎসব নেই যা বিলেতে উদ্যাপিত হয় না। এবারের একুশের বইমেলায়ই ব্রিটেনের কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের কবিতা, গল্প, গান, উপন্যাসসহ অর্ধশতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশে সেরা লেখক বা পদকে ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে  এ কথা জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন  জুয়েল রাজ। 

কঠিন হলেও সত্য, এ দেশে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম বাংলা বলতে পারলেও লিখতে বা পড়তে পারে না। ব্রিটেনে বাংলাভাষী পরিবারগুলোয় মাতৃভাষার চর্চা কমবেশি থাকলেও সেটি শুধু মৌখিক বা কথ্য ভাষায় আছে। একটা সময় ছিল, অভিভাবকরা বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সন্তানদের বাংলা অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতেন। অতীতে ‘সেকশন লেভেল ফান্ডিং প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। আট বছর আগে শুরু হয় ‘এ লেভেল’ ও ‘জি সি এসি ইভিনিং স্কুলে’ ছয় বছর থেকে শুরু করে ১৫ বছরের শিশুদের কাউন্সিলের অর্থায়নে মাতৃভাষা শেখানো। সেখানে আফটার স্কুল কার্যক্রমের আওয়তায় বাংলা শিক্ষা দেওয়া হতো। সম্প্রতি কাউন্সিল সেই অর্থায়ন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী মাস থেকেই শুরু করে আগামী দুই বছরে অর্থায়ন কমিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। মাতৃভাষার এই প্রকল্পে বাংলাসহ ১০টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে আসছিল।

নতুন নিয়মে, ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের অভিভাবকদের নিজেদের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে যেহেতু বাংলাদেশিদের আধিক্য, সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা শিক্ষা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। স্থানীয় মসজিদ ও উদীচীর মতো সংগঠনসহ ৪২ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যম এই ভাষা শিক্ষা প্রকল্প পরিচালিত হতো। সোমালিয়ান ছেলে বাংলা ভাষা শিখেছে, এমন উদাহরণও আছে। এই প্রকল্পে বর্তমানে এক হাজার ৬০০ ছাত্র-ছাত্রীর ৭০ শতাংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। ২০ বছর ধরে চলে আসা এই বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম যখন চালু হয়েছিল, তখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাঙালি কাউন্সিলর ছিলেন মাত্র দুই থেকে তিনজন। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ২৫। প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রায় অর্ধশতাধিক আফটার স্কুলের বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।

১৯৮২ সালে একটি প্রাইমারি স্কুলের নামকরণ করা হয়েছিল ওসমানী প্রাইমারি স্কুল, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানীর নামে। দুই বছর আগে হঠাৎ স্কুল কর্তৃপক্ষ ওসমানীর নাম বদল করে ভ্যালেন্স প্রাইমারি স্কুল করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, মুসলিম নাম থাকায় এখানে অন্যান্য এথনিক কমিউনিটির শিক্ষার্থীরা কম ভর্তি হচ্ছে এবং স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে না। এমন প্রস্তাবের চিঠি অভিভাবকদের কাছে পাঠানো হলে তাঁরা ক্যাম্পেইনে নামেন। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ ভোটাভুটির প্রস্তাব দিলে ওসমানী নামের পক্ষে বেশি মত আসে এবং নাম বহাল থাকে। স্কুলটিতে অধ্যয়নরত মোট ৪১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫৭ জনই বাঙালি বংশোদ্ভূত।

অভিভাবকদের আশঙ্কা, ভাষা প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে বাংলা শিক্ষা ও চর্চার কবর রচিত হবে। কারণ নতুন প্রজন্ম বাংলা শিক্ষার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। অভিভাবকরাও পকেটের পাউন্ড খরচ করে বাংলা শেখাতে আগ্রহী হবেন না। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের বিশেষ আগ্রহ থাকায় এবং নানা পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। বিগত এক দশকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের কারণে এখানে বাংলার চেয়ে আরবি সংস্কৃতি ধারণ ও চর্চা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশির দশকে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম এবং বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা মানুষের মধ্যেই এখনো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা বিদ্যমান। তাদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে খুব একটা সংশ্লিষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিগত এক দশকেই ১০ থেকে ১২টি বাংলা কাগজের মধ্যে বন্ধ হতে হতে পাঁচটি কোনোভাবে টিকে আছে। বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল এরই মধ্যে দুটি বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচটি চ্যানেল যদিও এখনো ঠিকে আছে, ভবিষ্যতে কতটুকু টিকে থাকবে এই ভাবনা রয়ে গেছে।

ব্রিটেনপ্রবাসী বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ভাষা বহমান নদীর মতো। এর জোয়ার-ভাটা যেমন আছে, পরিবর্তনও আছে। ব্রিটেনে বাংলা গণমাধ্যম হয়তো টিকে থাকবে না। কিন্তু বাংলা ভাষাটা ভাঙাচোরাভাবে থেকে যাবে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরো কয়েক প্রজন্ম চলে যাবে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ব্রিটেনের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষাটা শিখবে কেন? যে ভাষা তার ব্যাবহারিক জীবনে কোন কাজে আসবে না তা শেখার প্রতি আগ্রহ থাকার কথা না। যেহেতু বাংলাভাষী বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখানে আছে এবং বাংলাদেশের সাথে তাদের একটা যোগাযোগ আছে, এই কারণে মুখের ভাষা হিসেবে, বাংলা কোনোভাবে টিকে থাকবে হয়তো। বিলেতের বাংলা ভাষা অভিভাবকদেরই টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।’

ব্রিটেনে দুই প্রজন্মের দুই নারী, কবি শামীম আজাদ ও আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীন। তাঁরা দুজনই সিলেটের মেয়ে, কিন্তু বিয়ে করেছেন সিলেটের বাইরে, সেই সুবাদে সন্তানদের প্রমিত বাংলা শিখিয়েছেন। কিন্তু সেদিন এক আড্ডায় দুজনই স্বীকারোক্তি দিলেন, রেগে গেলে কিংবা খুব আদর করে যখন সন্তানদের তাঁরা ডাকতেন বা ডাকেন তখন মন থেকেই সিলেটি ডায়ালগে ডাকেন। ভাষা জিনিসটাই মনে হয় আসলে এমন। আমি অনেককে দেখেছি অনর্গল ইংরেজি বলছেন, মাঝখানে হঠাৎ অবচেতনভাবে ‘না মানে, কিন্তু’ এজাতীয় বাংলা শব্দ ব্যবহার করে ফেলছেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রজন্মের মধ্যে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে। বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034689903259277