বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ জিনিয়া তাঁর ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বেশ হেনস্তা করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতিও অভিন্ন প্রশ্ন তুললেন। বোধগম্য, বাংলাদেশে সরকারি অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকায় ঘাটতি-কমতি আছে বলেই এমন প্রশ্ন উঠেছে। আচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক; ফাতেমাতুজ জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। অর্থাৎ তাঁরা উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানটির অংশীজন; কাজেই তাঁদের প্রশ্ননিহিত উদ্বেগের সংগত কারণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পৃক্ত যাঁরা, তাঁদের সবার মনে এখন এমন প্রশ্ন আছে। তবে শুধু উত্তর নির্দেশ করলেই হবে না, বিশ্ববিদ্যালয়কেও তার কাজ প্রশ্নাতীতভাবে করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে কাজ করবে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা; লেখাজোখা প্রতুল এবং সেগুলোর আলোকে কিছু বলা যেতে পারে।  বুধবার (২২ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের  শরণাপন্ন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তাঁর কথা হলো, ‘...বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যা সম্পর্কে বিশেষ প্রীতি, গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্য স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি’ (‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’)। আর এমনিভাবে ইউরোপের অনেক আগে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নালন্দা বিক্রমশীলা ও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তাদের উদ্ভব ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায় ও স্বভাবের অনিবার্য আবেগে’; যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে সক্রিয় কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। চিত্ত, প্রেরণা ও স্বভাব নয়; বরং রাজনীতি এবং ব্যবসা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে) প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তা বুঝতে রবীন্দ্রনাথের আরো দুটি কথা প্রণিধানযোগ্য: ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ’; এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র।’ বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন এবং সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান; যার কর্মী শিক্ষককে হতে হবে বিদ্যান ও জ্ঞানী। আহৃত বিদ্যা ও চিন্তা উৎসারিত ভাবনা শিক্ষকের চিত্তে প্রজ্ঞা (knowledge) ও সজ্ঞার (wisdom) সৃজন করবে। ফলে শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা ও সজ্ঞার স্পর্শ পাবে। চিন্তাহীন (thoughtless) বিদ্যা শিক্ষার্থী বা সমাজ কারো হিত করে না। এ জন্যই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন উচ্চারণ করেছিলেন উপলব্ধ সত্য : ‘Your imagination is more important than knowledge.’ যে প্রতিষ্ঠানে প্রজ্ঞার চর্চা হয়; প্রজ্ঞার সৃজন সঞ্চালন হয় তা-ই বিশ্ববিদ্যালয়।

জন হেনরি নিউম্যান বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা তাড়িত হয়ে বই লিখেছিলেন The Idea of a University (লন্ডন : লঙ্গম্যানস গ্রিন, অ্যান্ড কো., ১৯০৭)। তিনি অবশ্য অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণে স্নাতক পর্যায়ে পঠন-পাঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু জার্মান রীতিতে গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ গুরুত্ব পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধিতে আছে শিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ এবং যা অবশ্যই বিশ্বমানের হতে হবে।

গবেষণা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে। উপরন্তু গবেষণাহীন উন্নয়ন অকল্পনীয়; আর এ কারণে তৈরি হয়েছে শব্দযুগল Research and Development (R&D)। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বসাম্প্রতিক ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার করুণ দশা চিত্রিত হয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের জনবিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। এখানে গবেষণার জন্য আছে সেন্টার ফর হায়ার স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ। সেন্টার সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে মুজিববর্ষে প্রকাশিত হবে বঙ্গবন্ধুর ওপর ইংরেজিতে বিশ্লেষণাত্মক জীবনী গ্রন্থ; পরবর্তী সময়ে মূল বইয়ের বাংলা অনুুবাদ প্রকাশিত হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়ারের ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয় হবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তির কেন্দ্র। উল্লেখ্য, চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় না। সব মানুষের মধ্যে আলো আছে; কিন্তু তাদের সে আলোয় আলোকিত করতে হলে প্রয়োজন চর্চা ও প্রশিক্ষণ, আর সে কাজটিই করেন আলোকিত-প্রাণিত শিক্ষক। শিক্ষক নিজে আলোকিত-প্রাণিত হবেন, শিক্ষার্থীকে আলোকিত-প্রাণিত করবেন। এ কারণে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘Education is bringing out the good already in man.’ আর এ কারণেই জন নিউম্যানের ভাষায় শিক্ষকদের থাকতে হবে, ‘Philosophical habit of mind’—দর্শন-অভ্যস্ত মন। অন্যদিকে প্রজ্ঞা ও সজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ার তৈরি শিক্ষকের চিত্ত হবে হিমাদ্রিসম উন্নত এবং অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের ভাষায় তিনি সদাসাহসী হবেন, কারো রুষ্টতা ও তুষ্টতার তোয়াক্কা না করে তাঁর কাজ হবে ‘speak truth to power’ নোয়াম চমস্কির ভাষ্যও অভিন্ন।

বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্নমতের চারণক্ষেত্র। স্বাধীন চিন্তা বিকাশে ভিন্ন মতের পোষকতার বিকল্প নেই। ভলতেয়ারকে স্মরণ করে বলা উচিত : ‘তুমি যা বলো তা আমি ঘৃণা করি; কিন্তু তোমার তা বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে সংরক্ষণ করব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নির্ভর করে উপাচার্যের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর। বাংলাদেশে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনীতিদুষ্ট এবং ত্রুটিপূর্ণ; আর সে কারণে প্রায়ই ত্রুটিপূর্ণ উপাচার্যের সুবাদে নিয়োগকারী সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই বিপন্ন হয়। উপাচার্য নিয়োগ হবে ভারতের মতো ‘সার্চ কমিটির’ মাধ্যমে, দলীয় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নয়। আচার্য মানে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী; উপাচার্য তাঁর কাছাকাছি। উপাচার্য জ্ঞানী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। প্রশ্নবিদ্ধ প্রজ্ঞা-সজ্ঞার মানুষের দ্বারাই অবিমৃশ্যকারিতা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শুধু প্রজ্ঞা-সজ্ঞার ফেরিওয়ালা নন, তিনি মনুষ্যত্বের বাতিঘর। তাঁর প্রণোদনায় শিক্ষার্থী শুধু বিদ্যান হবেন না, আলোকিত মানুষও হবেন। আবার স্মরণ করছি রবীন্দ্রনাথকে। তিনি ১৬ বছর বয়সে ১৮৭৭ সালে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সৃষ্টিছাড়া এক শিক্ষাপ্রণালি প্রচলিত রহিয়াছে যাহাতে শিক্ষার্থীর রুচির পরিবর্তন হয় না, তাহারা স্বাধীনভাবে চিন্তাও করিতে পারে না।’ (শিক্ষার হেরফের) আজ এত দিন পরে আমাদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে এ দুটি বৈশিষ্ট্য কি পাওয়া যায়? নির্দ্বিধ উত্তর : না। আর তার জন্য ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রশাসকদের। সর্বোপরি, শিক্ষকের (সব পর্যায়ের) কর্তব্য হলো, শিক্ষার্থীকে আচরণ, বচন, বসন ও বিচরণে মানুষ করে তোলা।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? রবীন্দ্রনাথ সোজাসাপটা উত্তর দিয়েছিলেন, যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ উৎপাদিত বিদ্যা বিতরণই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিদ্যা বিতরণ ও উৎপাদন করবেন। আর সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে মুক্তবুদ্ধির প্রতিষ্ঠান। এ কথাটি মনে রেখে ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নবীন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ; তাঁদের পত্রিকা ‘শিখা’র শীর্ষে বাণী ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো, মুক্তির প্রণোদনা সৃষ্টি করা। 

 

লেখক : ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045459270477295