বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন :প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন |

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল কাজ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা। একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানবসভ্যতার বিস্তার ও মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের সৃজন ও বিস্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। 'উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়' রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা, গবেষণা কার্যক্রমের বিস্তার ও পরিপোষণে যুগোপযোগী নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। সেখানে ছাত্রদের নির্বাচিত নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকলেও শিক্ষকদের বিভিন্ন ফোরামের নির্বাচন নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি পাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যকার নির্বাচনগুলোর অন্যতম একটি হলো শিক্ষক সমিতি নির্বাচন; যার মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষা এবং নানাবিধ বিষয়ে সুফলপ্রাপ্তির এক 'বার্গেনিং ফোরাম' হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এসব শিক্ষক সমিতির। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সমন্বয়ে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষক সমিতি; যেটির নাম বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। বর্তমানে এটির সভাপতি ও মহাসচিব পদে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত দুই শীর্ষ শিক্ষক নেতা, যথাক্রমে অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল ও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। গত ২০ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত 'বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন' উপরিউক্ত ফেডারেশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বস্তুত জ্ঞান ও শিক্ষা পরিবারের জন্য ২০ অক্টোবর এক ঐতিহাসিক দিন, খুশির ও স্মরণীয় দিন। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন বৃহত্তর মিলন মেলা আর কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ ও অভূতপূর্ব এ মিলন মেলা দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার যে স্বপ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন সেই ঈপ্সিত লক্ষ্য পূরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বর্তমানে ৪৪টি; এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭টি, রাজশাহী বিভাগে ৫টি, খুলনা বিভাগে ৫টি, বরিশাল বিভাগে দুটি, সিলেট বিভাগে তিনটি, রংপুর বিভাগে দুটি ও ময়মনসিংহ বিভাগে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। মানসম্মত শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত। উন্নত জাতি বিনির্মাণে টেকসই শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দ্যুতিময় অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়া অত্যাবশ্যক। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সব ক্ষেত্রের মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন আজ সময়ের দাবি। অবশ্য এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা ও জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। ন্যায়-নীতি-নিষ্ঠ, পরমতসহিষুষ্ণ, মূল্যবোধসম্পন্ন, উদার-অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ নির্মাণেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সে লক্ষ্য পূরণেই কাজ করা।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেশাগত প্রত্যাশা ও প্রার্থিত প্রাপ্তির চাহিদা কোনোকালেই রাষ্ট্র বা সরকারের সাধ্যসীমার বাইরে যায়নি। তারা কখনোই রাষ্ট্রের কাছে অযৌক্তিক কোনো চাওয়া-পাওয়ার দাবি তোলেননি। শিক্ষক হিসেবে প্রাপ্ত সম্মান ও অবস্থানের মর্যাদাটিই তাদের কাছে বরাবরের মতো এখনও মুখ্য। তবে এ কথাও সত্য যে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন ও লক্ষ্যগুলো পরিপূরণে শিক্ষকদের আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক, যাতে করে জ্ঞান-গবেষণার কাজে পূর্ণ মনোযোগী হতে পারেন। আজকে বলা হচ্ছে, শিক্ষায় অর্থ ব্যয় খরচ নয়, বিনিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নূ্যনতম সুবিধাদি নিশ্চিত করা এবং উচ্চশিক্ষায় বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা কোনোমতেই অর্থের অপচয় হবে না; লাভজনক ও সর্বোত্তম বিনিয়োগ হয়ে বরং তা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বিশেষ ফল বয়ে আনবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ থেকে ২৫ বছর আগে তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন- 'আমরা যদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, তাহলে শিক্ষাই হচ্ছে তার পূর্বশর্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সাধনা ছিল বাংলার মানুষের স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন- আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকার পায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর তাঁর কন্যার অদম্য কর্মপ্রয়াসে বাংলাদেশ আজ শিকড় থেকে শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে। আর এ অগ্রযাত্রাকে টেকসই রূপ দিতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, প্রত্যাশা, চাহিদা আর প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। অবশ্য সরকারের প্রধান নির্বাহী ইতিমধ্যেই স্বপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষকদের চাহিদা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে লিখিত চেয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা ন্যায়সঙ্গত বিষয়াদি মেনে নেবেন এবং শিক্ষকদের অবস্থান ও মর্যাদার কথা ভেবে তাদের জন্য নূ্যনতম প্রার্থিত সুবিধাদি নিশ্চিত করবেন। সম্মেলন শেষে সারাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মধ্যে একটাই তাগিদ অনুভব করা গেছে যে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ লিখিত আকারে দাবিগুলো পেশ করবেন এবং নিদেনপক্ষে এই মুহূর্তে সরকারের জন্য সাধ্য-সামর্থ্যের আওতায় যতটুকু সম্ভব, তা বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হবেন। এই সফল সম্মেলন কার্যত তখনই শিক্ষকদের হৃদয়াকাশে পরিতৃপ্তির আলোকপ্রভা বিকিরণ করবে; নচেৎ তারা হতাশার তিমিরেই ডুবে থাকবেন। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে শিক্ষক রাজনীতিতে। অনেকের মনে শিক্ষক নেতৃত্ব সম্পর্কে থাকা যেসব সুপ্ত গুঞ্জন, অনাস্থা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ, সেগুলো আরও শক্তভাবে দানা বাঁধবে- এতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।

লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067539215087891