এক যুগ ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ঘরে বসেই তৈরি করে আসছিল একটি চক্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চক্রটি বেশি তৈরি করতে বেসরকারি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। মাত্র ১০০ টাকা খরচে তৈরি হওয়া এসব সার্টিফিকেট বিক্রি হতো ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর এসব সার্টিফিকেটের গ্রাহক ছিলেন পাবলিক পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে পাস করা, অথবা অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীরা। এছাড়া বিদেশে ডিগ্রি নিতে যাওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা। ইতোমধ্যে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে অনেকেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাকরি নেয়ার পাশাপাশি বিদেশেও স্কলারশিপের সুবিধা নিয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে জাল সার্টিফিকেট তৈরির কারখানার সন্ধান মেলার পর জড়িতদের গ্রেপ্তারে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
গত বৃহস্পতিবার রামপুরা ও লালবাগ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরির মূল কারিগর প্রকৌশলী জিয়াউর রহমানসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবির লালবাগ বিভাগের একটি টিম। অভিযানের তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান। অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের হেফাজত থেকে বিপুল পরিমাণ তৈরিকৃত জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট উদ্ধারের পাশাপাশি জব্দ করা হয়েছে বিভিন্ন সরঞ্জাম।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান ইতোপূর্বে জাল সার্টিফিকেট তৈরির অভিযোগে কমপক্ষে ৪ বার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই জামিনে বের হয়ে এসে ফের একই কাজ করেছেন। গত ১ যুগে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন চক্রটি কয়েক হাজার সার্টিফিকেট সরবরাহ করেছেন। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি, ইন্ডিপেন্ডেট ইউনিভারসিটি থেকে শুরু করে এমন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ ছিল না যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট জাল তৈরি হয়নি। এর মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৪ কোটি টাকার চুক্তিতে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে দিতে চেয়েছিল এরা। এ জন্য মালিকপক্ষের সঙ্গে তাদের কথাবার্তাও হয়েছিল।
ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান ইস্টওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে টেলিকমিউনিকেশন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর একই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে পড়াশোনা করেছেন দেশের বাইরে। প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে সেই মেধা কাজে লাগিয়েছেন জাল-জালিয়াতির কাজে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে তৈরি এসব জাল সনদ বিক্রি করা হতো লাখ লাখ টাকায়। এভাবে জালিয়াতির অর্থে আয়েশি জীবন চলছিল প্রকৌশলী জিয়াউর রহমানের যিনি নিজেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক। আর তার এ কাজে সহযোগিতা করতো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা।
ডিবির ভাষ্য, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট পেতে ন্যূনতম খরচ ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে পড়াশোনা না করেই এমন সার্টিফিকেট মিলতো মাত্র ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দেয়া হতো, সেটির ওয়েবসাইটেও সেটি সংযোজন করে দেয়া হতো। আর এই সার্টিফিটেক তৈরির জন্য রাজধানীর লালবাগ থানার বড়ঘাট মসজিদ এলাকার কাশ্মীরি গলির বাড়িতে জীর্ণ দুটি কক্ষে গড়ে তোলা হয় কারখানা। পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া খালি মার্কশিট ও সনদে ছাপ দেয়া হতো সার্টিফিকেট প্রার্থীর নামে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টিফিকেট মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল ও ট্রান্সক্রিপ্ট সরবরাহ করতো।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনলাইন বিজ্ঞাপন দিয়ে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করছে একটি চক্র এমন অভিযোগ আসে ডিবির কাছে। ডিবির কাছে তথ্য আসে চক্রটি সার্টিফিকেট, মার্কশিট, ট্রান্সক্রিপ্ট ও টেস্টিমোনিয়াল বানিয়ে দেয়। যাতে ওই সার্টিফিকেট নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এর বিনিময়ে তারা যাতে ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিতে পারে। মূলত এই লক্ষ্য নিয়েই তারা এসব নকল ও জাল সার্টিফিকেট তৈরির পর সরবরাহ করে। এমন তথ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান এবং তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ একাডেমিক সনদ, মার্কশিট, এনভেলপ ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার (৫ মে) ভোরে লালবাগের ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক বুলবুল আহমেদ বিপুকে। এ সময় বাসাটিতে জাল সনদ তৈরির যন্ত্রপাতি ও উপকরণ পাওয়া যায়।
ডিবির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, চক্রটি দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বোর্ডের সব ধরনের গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট/ মার্কশিট ঘরে বসে তৈরির পর বিক্রি করে আসছিল। এমনকি ২০১৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান ইউনির্ভাসিটির সার্টিফিকেটও বিক্রি হয়েছে। প্রকৌশলী জিয়ার টার্গেট ছিল জাল সার্টিফিকেট বিক্রির টাকায় দেশের বাইরে ব্যবসায় কাজে লাগাবে। ইতোমধ্যে সে দেশে একটি ডেভেলপার কোম্পানি করেছে। ৪ কোটি টাকায় হাতিরঝিলে একটি বিলাশবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে। ওই ফ্ল্যাটেই জিয়া তার পরিবার নিয়ে থাকতো।
ডিবি বলছে, চক্রটি দুই ধরনের জালিয়াতি করতো। কোন রকমের ভেরিফিকেশন হবে না এরকম সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল ও দেশে-বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন হবে এরকম মার্কশিট, সার্টিফিকেট ইত্যাদি সরবরাহ করতো তারা। এ ঘটনায় কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির নাম পরিচয় পাওয় গেছে যারা অনলাইন ভেরিফিকেশন করে সার্টিফিকেট বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
ডিবি বলছে, চক্রের হোতা জিয়াউর রহমান। বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু এই উচ্চশিক্ষিত মানুষটি এক সময় শিক্ষায় কাজ করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন নকল সার্টিফিকেট তৈরির কাজে। জিয়া মূলত এই কাজ না করলেও তার একজন সহযোগীকে দিয়ে করাতো। তার নাম ইয়াসিন। আর তাকে এ কাজে সহায়তা করতেন দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ। তারা এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের কাছে এসব জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন।
ডিবির তদন্ত সংশিষ্টরা জানিয়েছে, প্রকৌশলী জিয়া এর আগে র্যাব, ডিবি, সিআইডি, পুলিশের হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে ফের একই কাজে জড়িয়ে পড়েছে। চক্রটি মূলত ব্যাকডেটেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্টিফিকেট বিক্রি করতো। তারা নর্থসাউথ ও ইনডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্টিফিকেট তারা তৈরি করতো। এছাড়া তারা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্টিফিকেট তারা বিক্রি করতো। এই চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি জড়িত। চক্রটি বিভিন্ন জনকে সার্টিফিকেট ও এডুকেশনাল কনসালটেন্সির কথা বলে কারও কাছে তিন লাখ কারও কাছে ১ লাখ ৮০ হাজার, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে চক্রটি। যেগুলোকে অনলাইনে দেয়া যায় না । যেসব সার্টিফিকেটে অনলাইনে ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হতো ওইসব সার্টিফিকেট ৩ লাখ টাকা নিতো। ডিবি বলছে, এসব সার্টিফিকেট দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো জাল সার্টিফিকেট। এগুলোর ছাপ, লেখা, অ্যাম্বুস সব অরিজিনাল মনে হবে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেখতে পান, দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাসাটিতে দামি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ও এমবস মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করা খালি মার্কশিট ও সনদের ছড়াছড়ি। কর্মকর্তারা জানান, চক্রটি দুই ধরনের সনদ সরবরাহ করতো। কোন রকমের ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হবে না এ রকম সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল সরবরাহ করতো। আবার দেশে বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন করা যাবে এমন সনদও সরবরাহ করতো। আর যাচাই-বাছাইয়ে যেন ধরা না পড়ে সে জন্য চক্রটি তাদের দলে ভিড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। তারা টাকার বিনিময়ে অনলাইনে জাল সনদের নম্বর সরবরাহ করতেন।
চক্রের বিষয়ে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘চক্রটি মাত্র ১০০ টাকায় একটি সনদ তৈরি করে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করতো। আমরা ধারণা করছি, অন্তত কয়েক হাজার মানুষের কাছে সনদ বিক্রি করেছে তারা। দীর্ঘদিন ধরে জাল সনদ বিক্রির কথা তারা স্বীকার করেছে। চক্রের সদস্যরা এর আগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে, এই চক্রের অন্যতম হোতা প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান। জাল সনদ বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করেছেন। এই টাকা দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। খুলেছেন ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান। কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। গ্রেপ্তার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে সব রকমের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত অতি সূক্ষ্মভাবে জাল সনদের কাগজ ছাপিয়ে আনতেন। সে নিজেও বিভিন্ন গ্রাহকদের জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল ও ট্রান্সক্রিপ্ট দিতেন।