বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ: এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?

কাজী আলিম-উজ-জামান |

বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের এক ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। হলে তাঁর আবাসিক কক্ষের দরজায় লেখা থাকত, ‘মিজানুর রহমান (ছদ্ম নাম), বিএ (অনার্স) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম’। প্রচলিত আছে, একজন শিক্ষকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেই এই ফলাফল কবজা করে নেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত ‘বিভাগীয় ঝামেলায়’ তাঁর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া হয়নি।

কিন্তু মিজানুরের মতো ‘দুর্ভাগা’ অনেকেই নন। সবকিছু সামলে তাঁরা বেশ উতরে যাচ্ছেন এবং দিব্যি আছেন। আর রাজনীতির গলিপথে যাঁদের একটু-আধটু যাতায়াত, শিগগিরই হয়তো তাঁরা উঠে পড়ছেন দাপটের মহাসড়কে।

প্রসঙ্গটি টেনে আনা এ কারণে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। যে শিক্ষকেরা মানুষ তৈরি করবেন, যাঁদের হাতে তৈরি হবে দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁদের কারও কারও নিয়োগ নিয়ে যদি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তবে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? হয়তো কিছুই হতে পারে না, কারণ দুর্ভাগ্যই আমাদের ভবিতব্য!

সাত-আট মাস আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সরকার নির্দেশনা দিয়েছিল। কিছুদিন আলোচনা হলো। আবার চাপা পড়ল ঘটনার ঘনঘটায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা হুবহু এ রকম:

‘শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শুধু মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়, এতে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রার্থীর মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ হ্রাস পাবে।’

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। সরকার বা ইউজিসি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো নির্দেশনা মানতে বাধ্য করতে পারে না। সুপারিশ করতে পারে বড়জোর। তাই ইউজিসির ওই নির্দেশনাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করেনি। আর দশটা ছিন্নপত্রের মতোই হয়তো পড়ে আছে কোনো টেবিলে। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের টাকায় চলে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কারণ, একজন শিক্ষার্থী সেরা ফলাফল করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেন। তাঁর জন্য মৌখিক পরীক্ষাই যথেষ্ট। কারণ, এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টার একটি পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই কখনো কখনো না-ও হতে পারে। তারা আরও মনে করে, লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদও পড়তে পারেন!

কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা যাঁরা শিক্ষক হতে যাচ্ছেন, অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা লিখিত পরীক্ষায় বসতে আগ্রহী নন। তাঁদের কথা, তাঁরা তো লিখিত পরীক্ষা দিয়েই সেরা ফল অর্জন করেছেন। তাঁরা এখন একটি মামুলি সাক্ষাৎকার দেবেন আর নিয়োগপত্র নিয়ে বের হবেন!

যাঁরা এ রকম মনে করেন, তাঁদের গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত টিআইবির একটি রিপোর্টের ফলাফল স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে। ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে টিআইবি দেখে, আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ পদে নিয়োগে ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। ধরণি দ্বিধা হও!

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগের আগে থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম শুরু হয়। যেমন কোনো কোনো শিক্ষক পছন্দের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে তাঁদের ব্যবহার করে আগে থেকেই একাডেমিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীর একাডেমিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্ন জানানো এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। টিআইবি আরও বলছে, নিয়োগ বোর্ড গঠন, সুবিধামতো যোগ্যতা পরিবর্তন বা শিথিল করা, জবাবদিহি না থাকার মাধ্যমে এই অনিয়মের শুরু। আর ১৩টির মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ঘটানোর সুযোগ বিদ্যমান ছিল।

২.

এই প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। বরং উল্টোটা বলা যায়, কেবল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেই অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়তে পারে। বাদ দেওয়া সহজ হয় ‘অপছন্দের’ প্রার্থীদের, ‘ভিন্ন আদর্শের’ প্রার্থীদের।

সে ক্ষেত্রে একটা উপায় হতে পারে, একাডেমিক পরীক্ষার ফল এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলের সুসমন্বয়। তা হলেই কেবল নিয়োগ বোর্ড ইচ্ছেমতো নিয়োগ দিতে পারবে না হয়তো।

তবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আরও বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা দরকার বলে মনে করি। ফলাফলের দিক থেকে সেরা শিক্ষার্থী কোনো কোনো সময় সেরা শিক্ষক না-ও হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে অনেক শিক্ষককে পেয়েছি, যাঁরা নোট মুখস্থ করে এসে গড়গড় করে বলে গেছেন। কোনো প্রশ্ন করলে বরং বিরক্তই হয়েছেন। আবার কিছু শিক্ষককে পেয়েছি, যাঁরা শিক্ষার্থীদের অন্তর্লোকে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের টিচিং স্টাইল বা পড়ানোর ধরনটা বিবেচনায় নেওয়া খুব জরুরি—যে চর্চা এখন একেবারেই নেই বললেই চলে।

যাঁরা প্রভাষক পদে আবেদন করতে যাচ্ছেন, তাঁদের ভাবতে হবে, শিক্ষকতা পেশা কতটা ভালোবাসেন তিনি। নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে আগেই অন্তত এক বছরের লেকচার জমা দিতে হয়। একটি মূল্যায়ন কমিটি তা যাচাই করেন। মনঃপূত হলেই কেবল তিনি পাঠদানের যোগ্য হন। আর আমাদের দেশে কার্যত সকালে নিয়োগ পেলে দুপুরেই ক্লাস নেওয়া শুরু করেন শিক্ষকেরা!

সার্কভুক্ত অনেক দেশেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক ফলাফলের চেয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত গবেষণাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনামে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন না করলে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার আবেদন করতে পারেন না।

৩.

দীর্ঘদিনের চলে আসা সংস্কারের অচলায়তন ভাঙাও সহজ নয়। কিন্তু ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ বলে বসে থাকলে তো চলে না। লক্ষণীয় হলো, সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও লিখিত পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আর এগোয়নি। শুক্রবার সকালে মুঠোফোনে কথা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আবদুল্লাহ আল হাসানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এটা তো উচ্চ পর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির খুব বেশি করণীয় নেই। তারা হয়তো বড়জোর আরেকটি নির্দেশনা দেবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত, ত্বরিত এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ, নীতিপ্রণেতাদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করা। তারপর যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসা। বর্তমানে যেভাবে ‘ফ্রি স্টাইল’ চলছে, সেভাবে চলতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি পারে না পথ দেখাতে?

কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক

সৌজন্যে: প্রথম অালো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026469230651855