বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ কী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও বাংলাদেশে একটি স্বাধীন ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ গঠন করা সম্ভব হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য এটি কষ্টের এবং হতাশার। আরো দুঃখের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠিত (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২) হয়েছে, তার অবস্থা ‘ঢাল আছে তলোয়ার নেই’ ধরনের। মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকার এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

‘স্বায়ত্তশাসনের অজুহাত’ এবং ‘ইউজিসি আইন’ দ্বারা ইউজিসি নিজেই শৃঙ্খলিত। বাংলাদেশ ও ভারতে ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন’ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও পাকিস্তানে ২০০২ সালে উচ্চশিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশে যেখানে উচ্চশিক্ষা কমিশনের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল, সেখানে গত ৭ই মার্চ ২০১৭, উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল বিল-২০১৭’ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে এবং ৬ মে ২০১৯ কাউন্সিলের কার্যালয় উদ্বোধন করা হয়েছে। অথচ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন; বিদ্যমান আইন পরিবর্তন-পরিবর্ধন; প্রচলিত একাডেমিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন এবং শিক্ষার আবহ আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃতির লক্ষ্যে ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) একটি স্বাধীন উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের অপরিহার্যতা সময়ের দাবি।

পত্রিকায় প্রকাশ, দেশের ১১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান উপাচার্যদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকার বিব্রত। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে তদন্ত ও নজরদারি করছে। দেশের বাইরে যাঁরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসেছেন তাঁরা হয়তো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবেন, তুলনা করেন ও হতাশ হন। সেটা স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত এ কারণে যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খুব একটা এগিয়ে নেই। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ‘দাদাগিরি’; গবেষণায় মনোযোগের চেয়ে ভোট, সরকারি লোভনীয় পদ, ক্ষমতালাভ ও ক্ষমতা উপভোগ করাই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবার বিদেশে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন তাঁরাও ইতিবাচক কোনো অবদান না রেখে স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছেন। বাংলাদেশে বেশ কিছু সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক সম্মান। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সেটা নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতদূর এগিয়েছে, তারও একটা পরীক্ষা নেওয়া দরকার। প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি—না পিছিয়ে পড়ছি তার মূল্যায়ন কে করবে?

বাংলাদেশে নতুন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ অধ্যাপক ছাড়াই চলছে, তার ক্ষতির দিকটা কে বা কারা ভেবে দেখবে? অবসর নিয়েছেন এমন অনেক সম্ভাবনাময় অধ্যাপক আছেন, যাঁদের আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবিকাশের পথ সুগম করে তোলা যায়। জ্ঞান-গরিমায় প্রথিতযশা অধ্যাপক ছাড়া উচ্চশিক্ষা কল্পনা করা যায় কি? উচ্চমানের গবেষণা, একাডেমিক কিংবা উন্নয়নমূলক প্রবন্ধ বা পুস্তক প্রকাশে অনীহা অনেক শিক্ষকের রয়েছে। কারণ উন্নত বিশ্বের মতো গবেষণা, প্রবন্ধ বা পুস্তকের উপযোগিতা আমাদের দেশে একজন শিক্ষকের চাকরিজীবনে খুব বেশি প্রভাব রাখে না। সময় হলে পদোন্নতি মিলে যায়।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা যাচাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজগুলোয় (নিবন্ধন/শিক্ষার্থীর এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোয় (বিসিএসের মাধ্যমে) থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (শুধু মৌখিক পরীক্ষা) নেই। প্রচলিত শুধু মৌখিক পরীক্ষা মেধা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট কি না, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। এটি ধ্রুব সত্য যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় এবং রাজনৈতিক চাপ ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রায়ই নিরপেক্ষতা ও মেধা উপেক্ষিত হয়েছে। মেধা, দারিদ্র্য ও সম্মান পরাজিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম মেধা ও ক্ষমতাশালীর কাছে। একজন শিক্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রের আলোকবর্তিকা। শিক্ষককে চৌকস হতে হয়।

বিষয়গত জ্ঞান, পারদর্শিতা, দক্ষতা; প্রশ্নোত্তর, যুক্তিপ্রদান ও খণ্ডনে সক্ষমতা; প্রমিত বাংলা ও ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা, উপস্থাপনা ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ এবং যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলেই মৌখিক পরীক্ষার আগে লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি ‘ডেমো লেকচার’ প্রদানের আবশ্যক ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা যদি উপাচার্য ও নিয়োগ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকে, তাহলে তাঁদের মনঃপূত প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ যে উত্তীর্ণ হবেন না, এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। নিয়োগের জন্য একজন ভুল শিক্ষক নির্বাচনের অর্থ হলো কমপক্ষে ৩৫-৪০ বছরের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া। প্রথম সারির মেধাবী ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া যাকে-তাকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হিসেবে প্রবেশের অনুমতি রাষ্ট্র দেবে কি না সে দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

ইউজিসির একাধিক প্রতিবেদনসহ জাতীয় পত্রিকায় অনেকবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই দোষ তো আর শিক্ষার্থীদের নয়। তাদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে না পারার দায় যেমন আমরা শিক্ষকরা এড়াতে পারি না, তেমনি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও সেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যেকোনো সময়ের চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে সামগ্রিক অবস্থা উন্নততর। রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব না হলেও কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন না করা, মৌলিক বই পঠন, পরীক্ষা কেন্দ্রের কারণে ক্লাসের সমস্যা না হওয়া (সকালে ক্লাস ও বিকালে পরীক্ষা ব্যবস্থা) এবং প্রয়োজনীয় ক্লাস ও ব্যাবহারিক কার্যক্রম শিক্ষায় অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা শুরু হলেও শেষের দিকে এসে এটি আর সফল হয় না। ২০১৯ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে মানবতাবোধের পরিচয় দিয়েছে, আগামী বছর সব বিশ্ববিদ্যালয় সেই পথে অগ্রসর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। প্রায় ১২ বছর ধরে এটি হচ্ছে-হবে করতে করতে আর আলোর মুখ দেখছে না।

বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পেয়েছে একজন উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নারী শিক্ষামন্ত্রী। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে প্রায় চার দশকের সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণে বিচক্ষণতা ও পারদর্শিতা দেখানো ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’খ্যাত মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সামনে ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন’, সর্বজনীন ‘অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন’, সব শিক্ষকের জন্য ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো’ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে গঠনমূলক ও শিক্ষামূলক রাজনৈতিকচর্চা-সংবলিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ঐতিহাসিক হাতছানি। নিশ্চয়ই তাঁরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দৃষ্টান্তমূলক ইতিহাস সৃষ্টি করবেন, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান,পিএইচডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন
এবং  শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028119087219238