বিশ্বব্যাপী শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন বিষয়ক বিশ্লেষণ

আমিনা জে মোহাম্মাদ |

নিজের জীবনজুড়ে আমি শিক্ষার অভাবনীয় শক্তি ও ক্ষমতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা কীভাবে গতিশীল অর্থনীতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিতে অবদান রাখতে পারে, আমি তার সাক্ষী। আমি আরো দেখেছি, শিক্ষা কীভাবে ধীরে ধীরে ব্যক্তিকে বদলে দেয়। এখানে ব্যক্তির অবস্থান কী, তাতে কিছু যায় আসে না; বরং ব্যক্তি নিজেকে ঘিরে একটি দৃঢ় বোধ, একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে শেখে, যা তার ভবিষ্যেক সমৃদ্ধ করে।

তবে আমি আরো অবলোকন করেছি, তরুণ সমাজ ও তাদের সম্প্রদায় থেকে শিক্ষা ছিনতাইয়ের পরিণতি কী হতে পারে। আমার দেশ নাইজেরিয়ায় উগ্র ইসলামপন্থী দল বোকোহারাম উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও বাজে মতলবে তরুণ সমাজকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। বলতে গেলে এভাবে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের গোটা একটি প্রজন্মই হারিয়ে গেছে, যার পরিণতি ভয়াবহ ও বহুমাত্রিক। শিক্ষা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা তাদের মর্যাদা, সামাজিক অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্যসচেতনতা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তির সুযোগ হারাবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার শিকার হয়ে যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। 

আমরা জানি, স্কুলে প্রতিটি অতিরিক্ত বছর ব্যক্তির আয় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির পাশাপাশি গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের সব মেয়ে যদি ১২ বছর ধরে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, তবে তাদের উপার্জনের পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে, যার মোট পরিমাণ ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সব ছেলে ও মেয়ে যদি মাধ্যমিকের ধাপ অতিক্রমে সমর্থ হয়, তাহলে প্রায় ৪২০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন মোতাবেক, সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব।

আজকের এই অগাধ আন্তঃসংযোগের দুনিয়ায় শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার সুবিধাগুলো অনেক বেশি ব্যাপ্ত। শিক্ষা মানুষের ভেতর জ্ঞানের যে সঞ্চালন ঘটায়, এর মাধ্যমে সে তার গ্রহের সীমিত সম্পদের উৎস সুরক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি ও বৈচিত্র্য মূল্যায়নের পাশাপাশি বিদিত নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখে। 

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) বিশ্বব্যাপী মানব উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ধরে পরবর্তী ১৫ বছরের লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয়। উদ্যোগটি বিশ্বব্যাপী সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের প্রচেষ্টায় নতুন করে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ফলে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৩ থেকে ৯১ শতাংশ। বয়স হলেও স্কুলে না যাওয়া শিশুদের সংখ্যা আগে যেখানে ছিল ১০০ মিলিয়ন, তা কমে হয়েছে ৫৭ মিলিয়ন। তাছাড়া ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতার হার ৮৩ থেকে ৯১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

তবে এখনো অনেক কিছু বাকি। কেননা ২০১৬ সালে কমপক্ষে ২৬৩ মিলিয়ন ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। এ তালিকায় প্রায় অর্ধেকের মধ্যে রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা (স্পেশাল চাইল্ড)। এছাড়া প্রি-স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেও যে বয়সটা শিশুদের বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, তখন অর্ধেকেরও বেশি শিশু তাদের শৈশবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় বা তারা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় না।

দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষময় অঞ্চলগুলোয় আরো বেশি মন্দ পরিস্থিতি বিরাজমান। এ ধরনের এলাকায় স্কুলের বাইরে থাকা মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অন্যান্য স্থিতিশীল দেশের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি। এভাবে বিশ্বের প্রায় ৬১৭ মিলিয়ন শিশু-কিশোর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বাইরে রয়ে যায়। এ বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশের বই পড়া কিংবা গণিতবিষয়ক ন্যূনতম কোনো দক্ষতা নেই। শূন্যস্থানটি পূরণে সাহায্যের প্রয়াসে এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও (এসডিজি) শিক্ষার প্রতি বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এসডিজির চতুর্থ লক্ষ্য অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে বলা হয়েছে শিক্ষার শক্তিকে জোরালোভাবে ব্যবহার করার কথা। তবে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও বাধার ফলে সার্বিক প্রক্রিয়াগুলো বিঘ্নিত হতে পারে। তবু এক্ষেত্রে কী ধরনের কার্যকর কৌশলের প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে, তা আমরা জানি। 

প্রথমত, পরিবর্তনের সত্যিকার অনুঘটক হিসেবে বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও শ্রমবাজার পরিবর্তনের গতিবেগ বাস্তবায়নে খোদ শিক্ষার রূপান্তর আবশ্যক। উন্নত প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং, ব্লকচেইন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে। সম্ভবত নব এ প্রযুক্তিগুলো শিক্ষাগত ফলাফল উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সহায়ক। যেকোনো পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল দক্ষতা ও প্রযুক্তির নতুন বিষয়গুলো সংযুক্ত করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে পাঠ্যক্রমে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি যোগ হবে; বিষয়টি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে সবচেয়ে প্রান্তিক ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দিকে নজর দেয়াটা জরুরি। এক্ষেত্রে ইউনিসেফের ইনোসেন্টি রিপোর্ট কার্ড ১৫-তে প্রাপ্ত তথ্য কিন্তু মানসম্পন্ন বিদ্যালয়ের বলিদানকে বোঝায় না। এমনকি প্রতিবেদনটি সুনির্দিষ্ট করে বলে, ধনী কিংবা দরিদ্র যেকোনো পর্যায় থেকে উঠে আসা হোক না কেন, সামাজিকভাবে সমন্বিত স্কুলের পরিবেশে শিশুরা আরো ভালো কাজ করতে থাকে। এ ধরনের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির জন্য চর্চা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন উন্নয়ন সহযোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা, যা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে জোর দেয়ার মাধ্যমে মানবিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার শর্তগুলো বজায় রাখবে।

শিক্ষাব্যবস্থা ও সেবাগুলোকে সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য আর যা-ই হোক না কেন কাউকে বাদ দেয়া যাবে না, এমনকি শরণার্থীদেরও নয়। ইউনেস্কোর সর্বশেষ গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট গণনা করে দেখিয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে শরণার্থী ছেলেমেয়েরা প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন দিন স্কুলে যায়নি। এ দিনগুলো তাদের জীবন থেকে অগোচরেই হারিয়ে গেছে। শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে আটটি, যার মধ্যে দরিদ্র থেকে মধ্যম আয়ের দেশও রয়েছে, উল্লেখযোগ্য খরচের কথা বললেও শরণার্থীদের শিক্ষা প্রদানের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শরণার্থী নাগরিকদের স্কুল পরিচর্যা নিশ্চিত করার চাপ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ রাষ্ট্রই তাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এদের অন্তর্ভুক্ত করেনি। কিছু দেশ শরণার্থীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছে। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা প্রতিকূল পরিস্থিতি ডেকে আনার পাশাপাশি সামাজিক সংহতিকে বিনষ্ট করে। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলো অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বৈশ্বিক পারস্পরিক শর্তগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিতকরণের নির্দেশ প্রদান করে। 

শিক্ষাগত প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমানে যে পরিমাণ তহবিলের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শিক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রয়োজনীয় বার্ষিক তহবিলের ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতি পূরণে শুধু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাড়তি অর্থায়ন যথেষ্ট নয়, বরং আন্তর্জাতিক দাতাদের প্রতিশ্রুতির নবায়ন জরুরি।

প্রত্যেক মানুষেরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে। তাদের এ অধিকারকে সমর্থন করে এসডিজি পূরণে পরিকল্পিত কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের প্রয়োজন। জাতিসংঘ ও এর সংস্থাগুলোর ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন জোগাতে হবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আমরা কাউকে পেছনে ফেলে আসছি না কিংবা কেউ বাদ পড়ছে না।

 

লেখক: জাতিসংঘের উপমহাসচিব ও নাইজেরিয়ার সাবেক পরিবেশমন্ত্রী

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

সূত্রঃ বণিক বার্তা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003169059753418