১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ঢাকায় অবস্থানরত তার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করেছিল। বাদ পড়েনি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। শিশু রাসেল সেই ভয়ঙ্কর সময়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে সেন্ট্রিপোস্টের পেছনে। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে খুনিরা খুঁজতে থাকে তাকে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যায় তাকে।
ভয় পেয়ে রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ শিশু রাসেল তখনও জানতো না ঘাতকরা তাঁর পরিবারের সকলকে মেরে ফেলেছে। ‘সশস্ত্র ঘাতক তাকে বলে, চল তোর মায়ে কাছে। টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়।’ বাবা-মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে চমকে ওঠে আর কাঁদতে থাকে রাসেল। নিষ্ঠুর ঘাতকের দল মায়ের কাছে নিয়ে শিশু রাসেলকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়। নিথর শরীর আছড়ে পড়ে মায়ের শরীরে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
বেদনা ও দুঃখের স্মৃতির হাহাকার আজ আমাদের মাঝে ভেসে আসে শিশু রাসেলকে মনে হলে। প্রতিদিন শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতনের খবর দেখলে ভাবি, মানুষরূপী নরপিশাচরা কেন কঠোর যন্ত্রণাময় শাস্তি পায় না? ছোট্ট শিশু রাসেলের তো বেঁচে থাকার কথা। এ অবুঝ শিশুটি কী অন্যায় করেছে ? রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতি কী বাংলার আকাশ, বাতাসকে স্তব্ধ করেনি? কেন হানাদারদের হৃদয়ে শিশুর প্রতি ভালোবাসার স্থান হয়নি? আজ শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাসেলের প্রতি আমাদের ভালবাসা জাগ্রত করতে হবে। সকল শিশুর জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
ধর্ষণে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা হয়েছে। অথচ মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে শিশুর ওপর মাত্রাধিক বই, খাতার বোঝা দূরীকরণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিরব। মাত্রাতিরিক্ত বই খাতা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই, শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, মিড ডে মিল বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়নসহ শিশুদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষায় উন্নত দেশ ফিনল্যান্ডে শিশুদের পরীক্ষা ও বাড়িতে পড়ার কোন চাপ নেই। সেখানে বিদ্যালয়ই তাদের সব পড়াশোনার স্থান। পরীক্ষা ব্যবস্থা, বাড়িতে পড়ার চাপ আমাদের দেশে আদিকাল থেকে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক ও অভিভাবক বাড়িতে শিশুরা পড়াশোনা করবে না ও পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা এ কথা ভাবতেও পারে না।
উন্নত বিশ্বের আদলে বিদ্যালয়ই হোক শিক্ষার কেন্দ্র, জ্ঞান অর্জন হোক শিক্ষার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষক সংকট সর্বাগ্রে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সকল শিশুর জন্য অভিন্ন কর্মঘণ্টা, বই, মূল্যায়ন ব্যবস্থা আজকের দিনে কাম্য। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মতো শিক্ষকদের মর্যদা, বেতন ও জবাবদিহিতা গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষায় বাজেটের স্বল্পতা রেখে, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখে অগ্রসর হওয়া যাবে না। এ জন্য আমলাতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে । শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নতির মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।
কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে অভিন্ন বই, কর্মঘণ্টা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তুলতে হবে। অবিলম্বে ইউআরসির মাধ্যমে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিবেকবান মানুষ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ আপাময় জনসাধারণ রাসেলের কথা স্মরণ করে এ দেশের শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে শপথ গ্রহণ করুন। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সব শিশু যেন অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার না হয়। অসহায়ত্বের মাঝে যেন তাদের মরণ না হয়। শিশু রাসেল আজ সব শিশুর প্রতীক। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। এ প্রত্যাশায় শিশু রাসেল স্মৃতিচারণে শুধু বলতে চাই, শুদ্ধচিত্তে, দৃঢ় বিবেক নিয়ে, দৃপ্তভাবে শিশুর অধিকার নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভাষাময় হোক। এতে শিশুদের পাশাপাশি প্রিয় রাসেলের আত্মাও শান্তি পাবে।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।