বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা

অধ্যক্ষ মোঃ কাওছার আলী শেখ |

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। পৃথিবীর সব দেশের কাছে এ দিনটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার। শিক্ষক দিবসের পটভূমিকা বর্ণনার আগে শিক্ষা ও শিক্ষক সম্পর্কে সামান্য বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। 

শিক্ষা ও শিক্ষকতা একটি অন্যটির পরিপূরক। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে।   শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে 'শাস' ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘এডুকেশন' এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘এডুকেয়ার’ বা ‘এডুকাতুম'  থেকে। যার অর্থ বের করে আনা  অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। ভেতরের এ সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে আনার মহান ব্রত যাঁদের, তাঁরাই হলেন শিক্ষক। এ সম্পর্কে বিখ্যাত প্রবন্ধকার প্রমথ চৌধুরী বলেন,    ‘শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞান পিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, যিনি যথার্থ গুরু, তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্বোধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলেন।  সক্রেটিসের ভাষায়, ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ এরিস্টটল বলেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’

শিক্ষকদের এমন কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ সদস্যের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’ গঠিত হয়, এ আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো মিলে প্রণীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনের গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস' পালনের শুভ সূচনা করা হয়। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর থেকে বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’কে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের মতো বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ আজ সকাল দশটায় সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের’ সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম।

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন  শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের নানামূখী সমস্যার অবতারণা করেছেন । এমনই কতিপয় সমস্যা নিয়ে কিছু কথা  না বললেই নয়। শিক্ষা সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: 

ক) ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;’
সংবিধানের এই ধারাটির কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়?  আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তারা কি পেরেছেন একটি গণমূখী সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে? পেরেছেন কি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পাঠ দান করতে? 

আমরা ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে ভাষা আন্দোলন করলেও এ রাষ্ট্রে এখনও রয়েছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। এ রাষ্ট্রের নাকের ডগায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো মোটা অংকের  টাকায় ভিনদেশি ভাষাকে ফেরি করে ব্যবসায় করে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাভাষার প্রতি এদেশের  শিশু-কিশোরদের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও  ভালোবাসা অনেকাংশে হৃাস পাচ্ছে। অথচ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, একটি সাম্য ও বৈষম্যহীন  সমাজ বিনির্মাণে যুদ্ধ করেছে বাঙালি। আমরা কি পেরেছি জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে? 

মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন ও চাওয়া তার কতটুকুই বা এ সমাজে বাস্তবায়ন হয়েছে? এত শোষণ ও বৈষম্য এ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায়! আমরা দেখতে পাচ্ছি  শিক্ষা তথা শিক্ষক সমাজের সাথে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নানামুখী বিমাতাসুলভ আচরণ।  একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও  মর্যাদা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করে পদোন্নতি পেয়ে রাতারাতি তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে ফেলছে।  অপরদিকে মুখের বুলি সান্ত্বনা মেনে তালেব মাস্টারগণ হাতে নড়ি নিয়ে ঠুকঠুক করে বিদ্যা বিলিয়ে যান যুগ যুগ ধরে। আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা ‘তালেব মাস্টার’ কবিতার উদ্বৃতি দিয়ে বলতে চাই,

অক্লান্তভাবেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছি।
পানির মত বছর কেটে গেল
কত ছাত্র গেল, এল- প্রমোশন পেল
কিন্তু দশ টাকার বেশি প্রমোশন হয়নি আমার!

একজন শিক্ষক তাঁর সমগ্র অর্জনটুকু ঢেলে দেয় তার প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করলেও শিক্ষকের জীবনের যেন আলো ফুটে না। একই রাষ্ট্র, অথচ সীমাহীন বৈষম্যের শিকার এ জাতির শিক্ষক সমাজ। বিশেষত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও, নন-এমপিও শিক্ষকরা। আরও রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় একই বেসিক স্কেলে। কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মূল বেতনের ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া পান। তারা বৈশাখী ভাতা ছাড়াও বছরে মূল বেতনের সমপরিমাণ দুটি উৎসব ভাতা পান। সন্তানদের জন্যও ভাতা রয়েছে। তাদের প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে ৫ শতাংশ হারে। এ সবই যৌক্তিক এবং প্রয়োজনে আরও বাড়ানো উচিত।

অথচ বেসরকারি শিক্ষকগণ একই জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভূক্ত হলেও ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, বৈশাখী ভাতা, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতাসহ  নানারকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমনকি পূর্বে বেসরকারি শিক্ষকদের টাইম স্কেল প্রথা চালু থাকলেও বর্তমানে এটি বন্ধ রয়েছে।  বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেখলে উন্নত ও  উন্নয়নশীল বহু রাষ্ট্রেই শিক্ষকদের বেতন কাঠামো  আলাদা ও উচ্চাসনে। অন্যদিকে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ যেন এদেশের জলে ভাসা পদ্ম পাতার মতো অর্থহীন। এ কেমন অবিচার! সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যে বর্তমান আওয়ামীলীগ  সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য, তাদের তো এ বৈষম্য দূর করতেই হবে। 

বেসরকারি বিদ্যালয় শিক্ষকগণ এসব সমস্যার সমাধান দেখেন কেবল শিক্ষাব্যবস্থা ও সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে। শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের আশা নিয়ে গোটা জাতির শিক্ষক সমাজ আশার আলো দেখলেও আজও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।  শিক্ষার মান উন্নয়নে  প্রতি বছরই মোট জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের মতো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়। অথচ জাতিসংঘের চাহিদা  ও আমাদের অঙ্গীকার মোতাবেক  জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।  এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। আমরা যদি জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশও বরাদ্দ করতে পারি, তাহলে অন্তত আমাদের কিঞ্চিত আশা পূর্ণ হবে বলে আমার বিশ্বাস। শিক্ষকদের বেতন -ভাতা তথা সম্মানী নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন: লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বুলগেরিয়ায় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সরকারি আমাদের চেয়ে বেশি। এমনটা হলে আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় ঝুঁকবে, জাতি হবে আরও উন্নত, সমৃদ্ধ। 

শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা বৃদ্ধি  করতে হবে; এর জন্য বাড়াতে হবে বরাদ্দ। গবেষণার জন্য  আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশের মাটিতে পা বাড়ায়। গবেষণা তথা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশের মাটিতে গেলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিশ্চয়তার জন্য তারা  উন্নত জীবন-যাপণ ছেড়ে আর দেশে ফিরে আসতে চান না । যদি যথাযথ মর্যাদা ও উপযুক্ত সম্মানী দেয়া যায় তবে জাতির মেধাবী সন্তানেরা দেশের মাটিতে ফিরে তাদের মেধাকে এ দেশে কাজে লাগাতে পারে। শিক্ষকতার মতো   এমন মহান পেশায় আবার নতুন করে আশার আলো জাগবে। যে সকল শিক্ষকগণ পেশায় নিয়োজিত তাদের বেতন কাঠামো আরও উন্নীত করতে পারলে শিক্ষকগণ পাঠদানে আরও বেশি মনোযোগী  হবেন, তখন তাদের আর্থিক দৈন্যদশা দূর হবে; ক্লাসে পাঠদানের পূর্বে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে উপস্থাপন করবে, প্রকাশ করবে শিক্ষকদের শাণিত মেধা। তৈরি হবে সৃজনশীল মেধাবী জাতি।

 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047249794006348