‘আজি হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির’ কবি কাজী কাদের নেওয়াজ-এর ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার এই বিশ্বখ্যাত চরণটিই যেন যুগ যুগ ধরে শিক্ষক সমাজকে সত্যিই অনন্য এক সম্মানের আসনে বসিয়েছে যে আসন থেকে শিক্ষক নামক মহান মানুষটি অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার, সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন জাতিকে, মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে সহায়তা করে যাচ্ছেন কার্পন্যতার কোনরকম তোয়াক্কা না করে। সেই মহান শিক্ষকগণের সম্মানার্থে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। বাংলাদেশেও শিক্ষক সমাজ তাকিয়ে থাকে এই দিনের জন্য একটু আলাদা মন মেজাজে নিজেদের তুলে ধরতে যেদিনটাকে ঘিরেই চলে আগামীতে শিক্ষকতা নামক পথে চলার নতুন স্পৃহায় নতুন উদ্যমে, মনে জাগিয়ে তোলে ‘শিক্ষক মহান’ মর্যাদার সেই মহান সোপানটিকে।
‘শিক্ষক’ নামক পেশাটিকে ‘মহান’ নামক বিশেষনে ঠিক কবে কখন কোন প্রেক্ষিতে করা হয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানা না থাকলেও শিক্ষক নামের মানুষগুলোর নিকট সত্যিকার অর্থেই পেশাটিকে গ্রহন করতে কোন রকম কার্পন্যতার ছোঁয়া আছে কি না তা যাঁরা শিক্ষকতার সাথে জড়িত আছেন তাঁরাই ভালো বলতে পারেন তবে আমি কিন্তু গলা উঁচিয়ে বলতে পারি কি পেলাম আর নাই পেলাম বেশ ভালো আছি, বেশ আনন্দে আছি, বেশ সুখে আছি। অথচ যে সুখের আশায় চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছি হাজার কোটি লক্ষ কোটি টাকার বিছানায় দিন যাপন করে বিলাসবাহুল্যে ভরা জীবনের স্বাদ নিয়ে শেষে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে, দেখেছি অসহায়ত্ব করুণ জীবন। সেক্ষেত্রে পেশাটা কি সেটা না ভেবে নেশার টানেই কিন্তু এসব অযাচিত ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে যাদের কাছে বিবেক ন্যায়বোধ নীতিনৈতিকতার বালাই কোনকালে ছিল কিনা তাও বোধগম্য নয়। এবং শিক্ষকতা নামক পেশার মধ্যে থেকেও যে অনেকেই সেই অসত্য তথা মিথ্যা সুখের আশায় শিক্ষক নামক মহান পেশাকে কলুষিত করে নিজেকে মহান করতে চায় সেটাও এমন কোন ব্যক্তি নেই যে কারো অজানা।
তবে এতকিছুর পরেও শিক্ষক নামক এই মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে বিবেক ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে নীতিনৈতিকতা সত্যনিষ্ঠতাকে পুঁজি করে সামাজিক ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বুক ফুলিয়ে জাতি গঠনে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমি সেই মহান শিক্ষকগণকে মহান সেলুট জানাই আজকের এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে। তবে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বা শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত যাঁরা সেই শিক্ষার্থী অভিভাবক শিক্ষক যে বৈষম্য যে বঞ্চনা যে শোষণ তা থেকে শিক্ষক জাতি কতটুকু মুক্তি পেয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন শিক্ষার্থী শিক্ষকগণ বৈষম্য শোষণ আর বঞ্চনার মধ্য দিয়েই শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে হয়তো এই বুঝি শিক্ষা সংস্কার হচ্ছে এই বুঝি শিক্ষানীতি হচ্ছে এই বুঝি শিক্ষার সাথে জড়িত যাঁরা তাঁদের মাঝে আর কোন বৈষম্য থাকছে না। বৈষম্যের কথা বঞ্চনার কথা যদি বলতেই হয় তবে প্রথমেই আসে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা একটা স্বাধীন দেশে কাম্য হওয়ার কথা নয়। একই দেশে দুই নীতিমূলক এরকম সরকারি শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষার্থী আবার সরকারি শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক। এতসব শুনতে শুনতে তো আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই রাষ্ট্রের সরকার আসে সরকার যায়, সবাই আশার বানী শোনায়। শিক্ষা সংস্কারে মনোযোগ না দিয়ে বরং নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত সবাই অথবা এরকম বুলিও শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এবার যদি ক্ষমতায় আসি শিক্ষা অগ্রাধিকার পাবে। শুধু বুলি আর বুলি, কাজের কাজ কিছুই হয় না। শিক্ষা নিয়ে সদ্য পতিত স্বৈরাচারী সরকার তো শিক্ষার বারোটাই বেজে দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থী শিক্ষক অভিভাবকসহ সবাইকে এমন এক শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে গেছেন, বরং বেচারা কেউ কোন কথা বললেই বা বিরুদ্ধে কথা বললেই আর নিস্তার নেই। তবে সেই স্বৈরাচারী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ জাতি ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে দেশের মানুষসহ শিক্ষার্থী শিক্ষক অভিভাবকগণের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে। দেশে এখন এমন এক সরকার যার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন শিক্ষক, উপদেষ্টাগণের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আছেন, শিক্ষার্থীও দুইজন আছেন উপদেষ্টা যাঁরা ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। তাছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদেও শিক্ষার্থী আছেন, সরকারকে সহযোগিতা করতে সরকারের বাইরে তো অগণিত শিক্ষার্থী নেতৃবৃন্দ রয়েছেন যাঁদের নেতৃত্বে দেশে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন ছাত্র-জনতার সরকার যে সরকারের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কারের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করে দেশকে দূর্নীতির কালো থাবা থেকে মুক্ত করে নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা, সকল প্রকার বৈষম্য থেকে শ্রমজীবী পেশাজীবিসহ সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করা। আর তাই তো শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে সেই বৈষম্য শোষণ বঞ্চনা থেকে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই মুক্তি পাবে, সত্যিকারের শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে আমাদের এই নতুন বাংলাদেশ আজকের এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে জাতির এই প্রত্যাশা।সেক্ষেত্রে শিক্ষক সে যে কোনো স্তরেই হোক না কেন শিক্ষাদান পেশাটাকে সম্মান মর্যাদার পুঁজি করে খুঁজে ফিরে একটু আত্মতৃপ্তি একটু সুখ একটু শান্তি। তবে এত সুখ এত তৃপ্তির পরেও কেন জানি শিক্ষকগণকে মাঝে মাঝে হোঁচট খেতে হয়, মনের অজান্তেই মহান সেই শিক্ষক হারিয়ে ফেলে সেই সম্মান মর্যাদার স্থান যখন দেখে তাঁরই সামনে সেইসব ব্যক্তিরা যারাও একসময় ছিল ছাত্র, যাদের জ্ঞান আহরণের উৎস কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষক। সেইসব ছাত্রগন যখন কর্মজীবনে আসে তখন তাদের দৌরাত্ম্য খবরদারিত্ব আর মুন্সিয়ানা দেখে শিক্ষকের দুঃখ লুকানোর জায়গা থাকে না। অথচ যাদের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাড়াতে শেখানোর কারিগর ছিলেন সেই শিক্ষকই অথবা তাঁর স্বজাতীয় কোন কারিগর তখন শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা সহজেই অনুমেয়। এরকমটা হবেই না বা কেন সেই কবিতার চরণটি যখন শুধু কাগজেই থেকে যায়, যখন শুধু কথার ফুলঝুরি হয়েই থেকে যায়, আর্থসামাজিক অবস্থার বাস্তবতায় এর চিত্র যখন অনুপস্থিত, যা থাকে শুধুই কল্পনায় এবং এর চিত্র আমাদের দেশেই অহরহ। তবে বিশ্বের অনেক দেশ যারা শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে, সেখানে শিক্ষকগণের সম্মান মর্যাদা সর্বোচ্চ আসনে একথা না জানা মানুষ খুব কম আছে বলে মনে হয়। এবং শিক্ষাদানে নিয়োজিত এই মহান শিক্ষকগণের সম্মান মর্যাদা সেইসব দেশে যতটা উপরে ঠিক ততটা নীচে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে। বললেও বেশি বলা হবে না যখন দেখা যায় একজন প্রশাসন কর্মকর্তার অফিসে ঢুকতে গিয়ে শিক্ষককে নিতে হয় অনুমতি, যখন দেখি কোন শিক্ষক সে যে কোন স্তরের হোক না কেন যখন একজন শিক্ষককে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয় দরজায়, অপেক্ষা করতে হয় তাঁর ব্যক্তিগত অথবা পেশাগত কাজের নিমিত্তে। এমনও দেখা যায় রাষ্ট্রের নাগরিকগণের সেবক হিসাবে যাদের অবস্থান, রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসাবে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত সেই তারাই যখন শিক্ষকগণকে তাদের অধিন্যস্ত মনে করে আত্মতুষ্টির ঢেকুর গিলে তখন সেই ক্যাডার নামক ব্যক্তিগুলোর অথবা কর্মচারীগুলোর মনেই থাকে না শিক্ষক একটা আলাদা জাতিসত্তা, শিক্ষকরা কোন কর্মচারী নয়। অথবা শিক্ষক মনে করার জন্য কোন রকম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যখন অনুপস্থিত তখন শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা আর কোথায় থাকে তা আর নাই বা বললাম। তাই তো বিশ্বায়নের এই যুগে যদি সঠিক গুনগত যুগোপযোগী শিক্ষার লক্ষ্যে শিক্ষা সংস্কারসহ শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো না যায় অথবা শিক্ষা নামক মেরুদণ্ড সোজা করার ঔষধটির যিনি ধারক বাহক সেমানুষটির যদি সম্মান মর্যাদা দেয়া না হয় অথবা পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে দেয়া না যায় তবে জাতি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের লজ্জা ঢাকানোর আর কোন জায়গা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জাতি গড়ার কারিগরদের যখন নূন্যতম অধিকারটুকু পেতে সংগ্রাম করতে হয়, রাজপথে নামতে হয় তখন বিশ্ব শিক্ষক দিবস বাংলাদেশের জন্য শুধুই দিবস পালন। তাই তো রাষ্ট্র ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবকিছুর উর্ধ্বে থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য দূর করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার মর্যাদা ধারণ করার এখনই উপযুক্ত সময়। আর তা সম্ভব হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরেই এবং শিক্ষক সমাজও সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় যখন সেই চরণটিই ভেসে উঠবে বাংলাদেশের সকল শিক্ষকের হৃদয়ে- ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার’।
লেখক-সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি), ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইন্সটিটিউট পঞ্চগড়