বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও শিক্ষকদের অধিকার

মোঃ নজরুল ইসলাম রনি |

আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের দিন এবং শিক্ষক সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শুভক্ষণ। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর পালন করা হয় এ দিবসটি। পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষক সমাজের নিকট এদিন অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার।

 শিক্ষক দিবস পালনের ইতিহাস খুব বেশিদিন আগের নয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International) গঠিত হয়, এ আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর প্রণীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করা হয়।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর থেকে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে এই দিবসটি যথারীতি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International-EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি  প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এ দিবসটি পালনে সরকারিভাবে তেমন তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি এবং এদিনটিতে কোন সরকারি ছুটি নেই। ফলে শিক্ষক সমাজে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। বাংলাদেশে দুটি ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে। একটি সরকারি অন্যটি বেসরকারি। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৫ লাখ।

সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-বৈষম্য আকাশ পাতাল। প্রতিবার বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এই দিনে শিক্ষকদের দুঃখগাথা লেখনী কিংবা র‌্যালির মাধ্যমে কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলেও সহসা পরিবর্তন হচ্ছে না কিছুই। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে  ৮ম জাতীয় পে স্কেল বাস্তবায়ন হলেও সরকারি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এমন কী স্বাধীনতার ইতিহাসে বাংলাদেশে প্রথম বৈশাখী ভাতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চালু করলেও বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ সরকারিকরণ করা হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। এটি ভাল উদ্যোগ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে সরকারিকরণে শিক্ষক সমাজে চরম ক্ষোভ ও অন্তোষ দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ বেশ কয়েকটি সংগঠন নিয়ে আমরা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ লিয়াঁজো ফোরামের ব্যানারে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তীব্র শীতে হাজার হাজার শিক্ষক প্রথম দশদিন অবস্থান ধর্মঘট এবং পরের দশদিন আমরণ অনশনে ছিলাম চাকরি সরকারিকরণের দাবীতে। পরবর্তীতে ২৯ জানুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এজন্য শিক্ষক সমাজে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ বাংলাদেশের শিক্ষকদের কাছে যেন ম্লান হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশব্যাপী আজ কারণে অকারণে শিক্ষক নির্যাতন হচ্ছে। শিক্ষকদের চাকরির নেই কোন নিশ্চয়তা। ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্ম্যে শিক্ষক সমা৪০১টিজ আজ দিশেহারা। কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি। বঞ্চনা আর বেতন বৈষম্যের কারণে মেধাবীরা আজ শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিক্ষকরা যেভাবে সম্মানিত, বাংলাদেশে সেটি নেই। বেতন-বৈষম্যসহ নানা কারণে শিক্ষার গুণগত মান ক্রমশ ধ্বংসের দিকে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য কী, সেটা যেন আমরা শিক্ষক সমাজ ভাবতেই পারি না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল প্রাথমিক শিক্ষাসহ মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারিকরণ। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণের ঘোষণা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাঙালি জাতির যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তেমনি শিক্ষক সমাজ আমরা যেন চির এতিম হলাম। শিক্ষক সমাজ আজ অভিভাবকহীন। শিক্ষকদের আর্তনাদ, দুঃখ, বেদনা, বঞ্চনা শোনার কেউ যেন নেই। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। দেশে আকাশছোঁয়া উন্নয়ন হয়েছে। শুধু ছোঁয়া লাগেনি বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যাকাশে। তবে আমাদের বিশ্বাস, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাই আজকের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চেতনায় শীঘ্রই শিক্ষক সমাজের সকল ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক যোগে সরকারিকরণের ঘোষণা দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। পরিশেষে ২০তম বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সফলতা কামনা করছি এবং শিক্ষকদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

 

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও মুখপাত্র, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033559799194336