বিসিএস পাসের ১৪ বছর পর নিয়োগের গেজেট

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

মেধার সব ধাপ পেরিয়ে হয়েছিলেন বিসিএস ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত। কিন্তু অজানা কারণে নিয়োগ আটকে গিয়েছিলো। তাদের মধ্যে কেউ আছেন ১৪ বছর ধরে অপেক্ষায়, কেউ পাঁচ বছর ধরে ঘুরছেন আদালত আর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েও নেতিবাচক প্রতিবেদনের বাদ পড়া এমন ২৫৯ জনকে বুধবার নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

তাদেরকে আগামী পহেলা সেপ্টেম্বরের মধ্যে যোগ দিতে বলা হয়েছে। এতদিন আটকে থাকলেও তাদেরকে চাকরিতে যোগদানের পর দুই বছর শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করতে বলা হয়েছে।

তাদেরই একজন মাহবুব উল আলম। ২০১০ সালের অক্টোবরে ২৮তম বিসিএসে’র চূড়ান্ত ফলাফলে তাকে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর তার নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়নি।

মাহবুব উল আলম বলেন, “আমার নামে মামলাও ছিল না, পুলিশের রিপোর্টও ভাল ছিল। এরপরও আমার নিয়োগও হয় নি”।

২৮তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত এমন বাদ পড়া সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল চার শতাধিক।

বুধবার তাদের মধ্য থেকে যে ২৫৯ জনের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, তাদেরকে জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ অনুসারে ২২০০০-৫৩০৬০ টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এই নিয়োগপ্রাপ্তদের নিজ ব্যাচ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা বজায় রাখা হলেও তাদের কোন ধরনের বকেয়া আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হবে না।

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, “তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন সত্য। তবে যেহেতু তারা সার্ভিসে ছিলেন না বা যোগদান করেন নি সে কারণে তারা বকেয়া পাবেন না”।

বিসিএস পাসের ১৪ বছর পর গেজেট

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বা পিএসসির অধীনে ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর।

তার আগের বছর ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার।

ওই বছর বিপিএসসি চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের নামে গেজেট প্রকাশের জন্য তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

কিন্তু ওই তালিকার বেশ কয়েকজনের নাম বাদ দিয়েই চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

বুধবার ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস’এ বাদ পড়াদের নামে যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে ২৮তম বিসিএস’র আছেন সাত জন।

ওই তালিকায় প্রথম নাম মাহবুব উল আলমের।

মাহবুব উল আলম লছিলেন, “বিসিএস পাস করলাম। প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম। অজানা কারণে বাদ পড়ার পর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি বছর আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন এই হারানো সময়ের মূল্য আমি কোথায় ফিরে পাবো?”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক ছাত্র মাহবুব উল আলম বিবিএস’এ চাকরি বঞ্চিত হওয়ার পর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে চাকরি করেছেন। পরে সে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছেন।

ওই সময় চূড়ান্ত গেজেটে বাদ পড়াদের অনেকে উচ্চ আদালতে মামলা করেছিলেন। হাইকোর্ট থেকে তাদের নিয়োগ দিতে রায়ও দেয়া হয়েছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত ১৪ বছরেও তাদের নামে গেজেট হয়নি।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নতুন সরকার গঠনের পাঁচ দিনের মাথায় তাদের নামে গেজেট হয়েছে।

মাহবুব উল আলম বলছিলেন, তাদেরকে আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর চাকরিতে যোগদান করতে বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিনি যোগদান করবেনও।

কিন্ত তার যে চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা ১৪ বছর আগে সেখানে এখন যোগ দেয়া নিয়ে বেশ কষ্টের কথাও জানাচ্ছিলেন বিবিসি বাংলার কাছে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট নিয়ে যত প্রশ্ন

মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ‘পুলিশ যাচাইকরণ’ করে থাকে। সাধারণত এই ভেরিফিকেশন করে থাকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবি শাখা।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার থেকে গত কয়েক বছরে অন্য গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিসি অফিস দিয়েও কাজটি করা হচ্ছে বলে নিয়োগপ্রাপ্তদের অন্তত দু জন জানিয়েছেন।

সেক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক যাচাই ফর্মে দেওয়া ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়।

যেখানে শিক্ষার্থীরা কোথায় লেখাপড়া করেছেন, সর্বশেষ পাঁচ বছর কোথায় থেকেছেন, কিংবা তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি বা অন্য কোনো মামলায় গ্রেফতার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের ৩৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

কিন্তু চূড়ান্ত গেজেটে তাকে বাদ দেয়া হয়। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর তার নামে গেজেট প্রকাশ করা হয় নি।

কেন গেজেট হয় নি, সেই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের বলেন, “আমি কোন রাজনীতি করি না। আমার নামে কোন মামলা নেই। আমার বাবা এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। সে কারণে আমি ক্যাডার হয়েও বাদ পড়েছি”।

আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের বর্তমানে একটি এনজিওতে চাকরি করছেন সিনিয়র স্পেশালিস্ট হিসেবে। ২০১৭ সালে তার যোগদানের কথা থাকলেও সাত বছর পর তিনি এখন যোগ দিবেন।

২৮তম বিবিএস’র আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের  দাবি তার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার রিপোর্ট পুলিশের পক্ষ থেকে যায় নি সেটি তিনি নিশ্চিত। কী কারণে তাকে বাদ দেয়া হল সেই প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে অজানা।

বকেয়া আর্থিক সুবিধা দেয়া হবে না'
২৫৯ প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করার পাশাপাশি বলা হয়েছে, বাদ পড়া ওই প্রার্থীরা যোগদানের পর শিক্ষানবিশকাল অন্তত দুই বছর হবে। সরকার চাইলে এটি বাড়তেও পারে।

নির্ধারিত তারিখে যোগদান না করলে তিনি চাকরিতে যোগদান করতে সম্মত নন মর্মে ধরে নেওয়া হবে এবং এ নিয়োগপত্র বাতিল বলে গণ্য হবেও বলা হয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্তরা বলছেন, মেধার সব ধাপে যোগ্যতার পরিচয় দেয়ার পরও চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশের বাদ পড়েছেন শুধুমাত্র নেতিবাচক পুলিশ রিপোর্টের কারণে।

যে কারণে তাদেরকে অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ নানা ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।

গেজেটে বলা হয়েছে, তারা যোগদানের পর তাদের ব্যাচের নিয়োগপ্রাপ্তদের তারিখের সাথেই ভূতাপেক্ষা নিয়োগ হবে। তবে তাদের বকেয়া আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হবে না।

গেজেট থেকে নাম বাদ পড়ার পর আদালত যে রায় দিয়েছিলো সেখানে অনেকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা প্রাপ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন না।

সহকারী কমিশনার গেজেটে নাম যুক্ত হওয়ার পর মাহবুব উল আলম বলেন, “এই ১৪ বছরে আমি যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলাম সেটির কোন উত্তর আমাদেরও জানা নেই”।

যদিও তাদের কেউ কেউ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।

৩৫তম বিসিএস’র আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের বলেন, ''২০১৯ সালে আমাদের ১৭জনকে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ ও সিনিয়রিটি দিতে রায় দিয়েছিল উচ্চ আদালত। কিন্তু প্রকাশিত গেজেটে তার বাস্তবায়ন দেখা যায় নি। এখন আমার এই পদে যোগ দিবো যে বেতনে তার চেয়ে অনেক বেশি বেতন পাচ্ছি।''

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান  বলেন, “তারা শুধু আর্থিক না, দক্ষতার দিক দিয়েও পিছিয়ে পড়বেন। সামনের দিনগুলোতে এটি নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে। তবে সরকার এক্ষেত্রে নিজস্ব বিধি অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।''

সূত্র: বিবিসি বাংলা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029881000518799