বিশ্ব বাবা দিবস আজবৃদ্ধাশ্রমে কেমন আছেন বাবারা

গাজীপুর প্রতিনিধি |
ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার,
মস্ত ফ্লাটে যায় না দেখা এপার ওপার। 
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী,
সবচেয়ে কমদামী ছিলাম-একমাত্র আমি।
ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম,
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।
 
নচিকেতা এ গানটির বাস্তব দৃশ্য আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখা মেলে। যে বাবা শরীরের ঘাম জড়িয়ে সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের বড় করে তোলেন, সমাজে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টায় সারা দিন-রাত কাটিয়ে দেন, শেষ বয়সে এসে সেই বাবাদের ঠিকানা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। 
গাজীপুরের সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠাই হয়েছে এরকম ১১০ জন বাবার। এদের বেশিরভাগ বাবার জায়গা হয়নি তাদের সন্তানদের
বাড়িতে। বাধ্য হয়েই অনেকে নিজে থেকে আবার কোনো কোনো সন্তান বোঝা মনে করে বাবাকে রেখে গেছেন এ বৃদ্ধাশ্রমে। এখন তাদের কাছে এই বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠেছে আপন ঠিকানা। বাবা দিবসে এমন কয়েকজন বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কেমন আছেন তারা।
 
রফিকুল ইসলাম। বয়স ৬৭। পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। ঢাকার বড় বড় হাসপতালে কাজও করেছেন। সাংসারিক জীবনে চার ছেলে সন্তানের বাবা তিনি। দুই ছেলে চিকিৎসক এবং দুই ছেলে প্রকৌশলী। তারা সবাই স্বপরিবারে থাকেন আমেরিকায়। গত চার বছর আগে সন্তানরা তার মাকেও নিয়ে চলে যায় আমেরিকা। ডাক্তার বাবা বহু কষ্ট করে তাদের মানুষ করেছেন, কিন্তু তারা এখন উন্নত রাষ্ট্রের বসবাস করে তার খোঁজ রাখেন না। 

রফিকুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমি আজিমপুর থাকতাম। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও। একসময় বহু বন্ধু-স্বজন ছিলো। দুই ছেলেকে ঢাকায় পড়াশোনা করিয়েছি এবং দুই ছেলে পড়াশোনা করেছে আমেরিকায়। ব্রেইন স্টোক করে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকেও আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলো ছেলেরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নেয়নি। ব্রেনে সমস্যা হওয়ার পর স্ত্রী এবং সন্তানরা এখানে রেখে চলে গেছে। ঠিকভাবে ছেলেদের নামও মনে করতে পারে না। জীবনের এ করুণ সময়ে সন্তানদের কোনো খোঁজ না পেয়ে হতাশায় কাঁদছেন তিনি। 

রফিকুল ইসলাম আরো জানান, আমার যতো উপর্জিত সম্পদ ও নগদ টাকা নিয়ে চলে গেছে তারা। সব নিয়ে যাক কোনো আফসোস নেই কিন্তু এই বাবারটার তো খোঁজখবর রাখবে। তাও রাখেনি। এতো কিছুর পরও বাবা হিসাবে আমি এখনো সবসময় চাই আমার ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক। আমি যে ওদের বাবা এটা স্বীকৃতি দিক, বাবা হিসাবে এখন এটুকুই চাই।

 
তিনি বলেন, এই বৃদ্ধাশ্রমে নামাজ পড়ে, বই পড়ে এবং পত্রিকা পড়েই সময় কাটানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সময় কাটে না। মনে পড়ে স্ত্রী সন্তানদের কথা। 
 
অশ্রুসিক্ত নয়ন আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরেক বাবা ইসরাইল হোসেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, পোশাক কারখানায় চাকরি করতো ছেলে। ছেলের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। কয়েক মাস একসঙ্গে থাকার পর একদিন হাঠৎ ছেলে আর ছেলের বউ দেখি বাড়িতে নেই। বাড়িতে কয়েক মাসের ভাড়াও বাকি ছিলো সেগুলোও দিয়ে যায়নি। মাস পেরিয়ে গেলেও ছেলেও বউ ফিরে না আসায় এক মাস পর বাড়ির মালিক বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে। পড়ে কিছুদিন একটি মসজিদে আশ্রয় নেই। সেখন থেকেও চলে আসতে হয়। কোথাও কোনো জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়েই এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা শুরু করি। ছেলেদের কথা মনে পড়ে তারপরও এখানে অনেক ভালো আছি। 
 
তিনি বলেন, আমি ওর বাবা ছিলাম। আমাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কি এমন ক্ষতি হতো। কতো কষ্ট করে নিজে না খেয়ে সন্তানকে মানুষ করেছি। তারপরও ছেলে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল কেনো?
  
রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী (৭১) একসময় জনতা ব্যাংকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ। দুই ছেলে চাকরি করেন এক মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতেন। কিন্তু সেখানে তার জায়গা খুব বেশিদিন হয়নি।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলের বাসায় থাকতাম। ছেলের বউ এবং ছেলে দু'জনেই চাকরি করতো। আমাকে তাদের ঢাকার উত্তরার বাসায় তালা লাগিয়ে চলে যেতো। আবার তারা আসলে খুলে দিতো। সারাদিন বের হতে পারতাম না। ঘরের ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসতো। পরে খোঁজখবর নিয়ে নিজে থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছি। ছোট ছেলে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শুনেছি, কিন্তু খোঁজখবর নেয়া হয়নি। সৎভাবে জীবনযাপন করেছি। কখনো অবৈধ টাকা আয় করিনি। অবৈধ টাকা আয় করলে কোটি কোটি টাকার মালিক হতাম। সন্তানরা যদি এসে নিয়ে যায় তখন তো যেতে বাধ্য। কিন্তু তারা তো দেখতেও আসে না, নিতেও আসে না। শুধু মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে জানতে চায় কেমন আছি।
 
বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে কেন্দ্রটি স্থাপন করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দ্রটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ২১ এপ্রিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে সন্তানের কাছে আশ্রয় না পাওয়া এমন শতাধিক বৃদ্ধা বাবার। শিশুর শৈশবে নিজের সব সুখ বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের মঙ্গল নিশ্চিত করতেন এই বাবারা। সন্তানেরা সেই বাবাদেরই জীবন থেকে মুছে ফেলেছেন। অথচ সন্তানের মঙ্গল কামনায় দিন-রাত প্রার্থনায় রত এখানকার বাবারা। বর্তমানে এ কেন্দ্রে বৃদ্ধ পুরুষ রয়েছেন ১১০ ও নারী হয়েছে ৯৭ জন। অসহায় ও নিরুপায় বয়োজ্যেষ্ঠরা এ প্রবীণ নিবাসে বিনা খরচে থাকতে পারেন।

পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055890083312988