বেগম রোকেয়া এই সমাজ চেয়েছিলেন?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের স্মৃতি কখনও অমলিন হয় না। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও তারা যেন চোখের সামনে থাকেন। আর কিছু ব্যক্তিত্ব থাকেন, যারা পরিবারের সদস্য বা ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ না হয়েও একই ধরনের স্মৃতি তৈরি করেন। গণযোগাযোগের ভাষায় এ ধরনের স্মৃতিকে বলা হয় 'প্যারাসোশ্যাল' সম্পর্ক। এমনকি তারা যদি অন্য কোনো সময়ের হন, তাদের নিয়ে তৈরি হয় অদেখা স্মৃতি। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমার কাছে তেমনই ব্যক্তিত্ব। তার প্রয়াণ যদিও আমার জন্মের অনেক আগেই হয়েছে, তিনি যেন আমার কাছে অমলিন স্মৃতি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বেগম রোকেয়া যেন প্রতিদিন আমাকে শক্তি জোগান। তিনি যেন আমার আত্মার আত্মীয়। সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বেগম রোকেয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শিকড়েরও। আমার ও বেগম রোকেয়ার পিতৃভূমি একই অঞ্চল- রংপুর। শৈশবে মা-বাবা আমার কাছে বেগম রোকেয়াকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে কত কথা বলেছেন! বড় হয়েও আমার মা আমাদের বেগম রোকেয়ার সময়ের সমাজব্যবস্থার কথা বলতেন, তার সংগ্রামের কথা বলতেন। তিনি বাঙালি মুসলিম নারীর শিক্ষা ও মুক্তির জন্য কীভাবে জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেসব কথা বলতেন।

কাজের ক্ষেত্রেও আমি বেগম রোকেয়ার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করি। রংপুর গেলেই আমি একবার চেষ্টা করি পায়রাবন্দ ঘুরে আসতে। তারই মতো সমাজে নারীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পাশাপাশি নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কাজ করি। শ্নাঘার বিষয়, রংপুর অঞ্চলে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে স্থানীয়রা কিছু  গানও বেঁধেছে।

শুধু আমি নই, বাংলাদেশের প্রতিটি নারী বেগম রোকেয়ার আত্মার আত্মীয়। তিনি যে নারী সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা আমাদের যৌথ স্বপ্ন। বাংলাদেশের প্রত্যেক তরুণী বেড়ে ওঠে 'সুলতানার স্বপ্ন' বুকে ধারণ করে। কিন্তু বাস্তবতার কশাঘাতে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এই লেখা যখন লিখছি- সেদিনের সমকালেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারীর বঞ্চনার কত খবর! আমি নিশ্চিত, আরও অনেক খবর চার দেয়ালের আড়ালে রয়ে যায়। গুমরে গুমরে কাঁদে রোকেয়ার স্বপ্নের নারীরা।

মাঝেমধ্যে এও মনে হয়- বেগম রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীর যে উন্নয়ন চেয়েছিলেন, আমরা কি তার থেকে আরও পিছিয়ে গেছি। সন্দেহ নেই, নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে। আমাদের নারীরা শিক্ষা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে আগের তুলনায় এগিয়ে গেছে। কিন্তু সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকারে কি আরও পিছিয়ে যাচ্ছি? আমি দুই দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। মনে হয়েছিল, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে মই, তার প্রথম ধাপে অন্তত তাদের তুলে দিতে পারব। কিন্তু যখন গ্রামেও নারীর প্রতি সহিংসতার বীভৎস রূপ দেখি, আমার হতাশা জাগে। মনে হয়, আমরা কি মইয়ের প্রথম ধাপেও পৌঁছতে পারব না।

এটা ঠিক, কেন্দ্রীয়ভাবে নারীর ক্ষমতায়ন কম হয়নি। আমরা গত তিন দশক নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি। বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। এখন পেয়েছি নারী স্পিকার। রাজনীতিতে, প্রশাসনে, বিভিন্ন বাহিনীতেও নারীরা এগিয়ে আসছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের নারীটির কী অবস্থা? তিনি কি বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের সারথি হতে পারছেন? নাকি সহিংসতার শিকার হওয়ার প্রশ্নে বেগম রোকেয়ার সময়ের চেয়েও পিছিয়ে যাচ্ছেন? আমি দেখতে চাই, বাংলাদেশের প্রত্যেক নারী বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের পথে। আমরা যারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নানা মাত্রায় ক্ষমতায়িত হয়েছি, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের নারীটিকে সেই পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

আমাদের রয়েছেন অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মুক্তিসংগ্রামে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুরুষের পাশাপাশি। দুর্ভাগ্যবশত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই উপযুক্ত স্বীকৃতি পাননি। এমন অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফের স্বাভাবিক ঘরকন্নায় ফিরে গেছেন। তাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। বিশেষ করে বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে চাই। তাদের স্বীকৃতি পর্যন্ত ছিল না। আমি বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই যে, বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার কাজটি শুরু হয়েছে। এই কাজ আরও এগিয়ে নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমাদের এখনকার মেয়েরাও দেশের জন্য কাজ করতে, নিজেকে গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত হবে।

জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বেগম রোকেয়াকে আজ নানাভাবে স্মরণ করা হবে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, মুক্তিপিয়াসী বাঙালি নারীরা তাকে নিজের জীবন দিয়ে স্মরণ করছেন কি-না। এক শতাব্দী আগে তিনি যে নারী মুক্তির কথা বলে গেছেন, নারী মুক্তির পথ দেখিয়েছেন এবং 'জাগো গো ভগিনী' বলে নারীদের জেগে ওঠা ও জেগে থাকার তাগিদ দিয়ে গেছেন, তা আজও তাদের হৃদয়ে আমরা অনুরণিত করতে পারছি কি-না।

২০১৫ সালে সরকার আমাকে বেগম রোকেয়া পদকে সম্মানিত করেছিল। আন্তর্জাতিকভাবে অনেক পুরস্কার পেয়েছি আমি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুরস্কার যত বড়ই হোক, তা কখনও দেশের পুরস্কারের সমান হতে পারে না। এর মর্যাদা, অনুভূতি, স্বীকৃতি, সন্তোষ অনেক গভীরের বিষয়। কিন্তু আরও বড় স্বীকৃতি সেদিনই পাব, যেদিন আমার নীতি ও কর্ম প্রত্যন্ত গ্রামের নারীকেও শক্তি ও সাহস জোগাবে। বেগম রোকেয়া নিজে অনুপস্থিত থেকেও আমাদের প্রতিদিনই তো সেই শিক্ষাই দিয়ে যান।

দেশের প্রতিটি জনপদে আমরা যদি একেকজন বেগম রোকেয়ার জন্ম ও বিকাশ সম্ভব করতে পারি, তাহলেই বাঙালি নারীর মুক্তির পথ সুগম হবে। বিশেষভাবে আমি নতুন প্রজন্মকে বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা গ্রহণ করতে বলি। মনে রাখতে হবে, বেগম রোকেয়া নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই মুক্তির কথা বলতেন। তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন; কিন্তু ধর্মবিশ্বাস তার মুক্তচিন্তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সব ধর্মই কি নারীকে শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়ে মর্যাদার আসনে বসানোর কথা বলে না?

কেবল বেগম রোকেয়া নন, আমাদের দেশে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্রের মতো বিপ্লবীর জন্ম হয়েছে। তাদের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। নারীর জন্য শিক্ষা যেমন, তেমনই স্বাস্থ্যও কতটা জরুরি- এই মহীয়সী নারীদের দেখলে আমরা বুঝতে পারি। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার রীতিমতো ব্যায়াম করতেন। অথচ আমাদের মেয়েরা শারীরিক কসরত বা খেলাধুলা থেকে ক্রমেই সরে আসছে। টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনে মনোযোগ দিচ্ছে। গ্রামেও নারীরা সন্ধ্যা হলে সিরিয়াল দেখতে বসে যায়। আজকের প্রজন্ম, বিশেষত নারীদের বলব বেগম রোকেয়া বা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করতে। তারাই আমাদের সত্যিকারের 'আইকন'।

শেষ প্রশ্নটি করতে চাই, বেগম রোকেয়া বা প্রীতিলতা বা ইলা মিত্রের মতো সংগ্রামী নারীদের জীবনী নতুন প্রজন্মের নারীদের কাছে তুলে ধরার জন্য কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? আমাদের মেয়েদের জন্য প্রতি জনপদে নারী আইকন তৈরি করা দরকার। যাতে করে তার সংগ্রামে ও সাহসের অনুপ্রেরণা পায়। রোকেয়া দিবস পালনের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেগম রোকেয়ার লেখা, তার জীবন ও কর্ম, সংগ্রাম সম্পর্কে নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ পাঠ দেওয়ার দাবিও জানিয়ে রাখি।
 
বিবি রাসেল : আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্যক্তিত্ব, জাতিসংঘ শুভেচ্ছা দূত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025238990783691