বেসরকারি শিক্ষকের ঈদ টেনশন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বছরে দুটো মাত্র ঈদ৷ সে দুটো ঈদও যদি হাসিখুশি আর আনন্দ-স্ফূর্তির মধ্যে উদযাপন কিংবা পালন করা না যায় তাহলে এরচেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? অন্তত ঈদে যদি ছেলেমেয়ের আবদার ঠিকমতো রক্ষা করা না যায় তবে সেটি যে কোনো বাবা-মায়ের জন্য সীমাহীন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ ঈদুল ফিতরে ঠিকঠাক মতো ফেতরা কিংবা ঈদুল আযহায় যদি মনের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা কোরবানী আদায় করা না যায় তবে নিঃসন্দেহে তা যে কোনো মুসলমানের জন্য মর্মপীড়ার কারণ বটে৷ ঈদগুলো যদি পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দ উচ্ছাসে কাটানো না যায় তবে পুরো জীবনটাই মাটি৷ একদম অসার জীবন৷ আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায় সেটিই ফি বছর ঘটে চলেছে৷

অনেকের আশা ছিল জাতীয়করণে কিছুটা বিলম্ব হলেও অন্তত ষোল আনা ঈদ বোনাস পেতে আর দেরি হবে না৷ কিন্তু এ দেশের শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের না পাওয়ার ইতিহাসটি বড় মর্মান্তিক৷ বড়ই করুণ৷ বহু শিক্ষক এ যাবত সে বেদনাটি বুকে চেপে ধরে পরকালবাসী হয়েছেন৷ অনেকে সে বেদনা বুকে ধারণ করে ত্রিশ-বত্রিশ কিংবা ততধিক বছর ধরে যন্ত্রণার ঈদগুলো পার করে আসছেন৷ নতুন প্রজন্মের অনেক শিক্ষক এ কষ্টের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে শিক্ষকতা পেশা থেকে উদ্যম ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন৷ এ পেশার প্রতি দিনে দিনে তাদের অন্য রকম এক অনীহা জন্ম নিতে শুরু করেছে৷

ঈদ একটি শ্বাশত আনন্দ উৎসবের নাম৷ ধনী-দরিদ্র সবার আঙিনায় ঈদের দিন আনন্দের বন্যা উপচে পড়ে৷ মানুষ সারাবছরের দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে ঈদ আনন্দে অবগাহন করে৷ কিন্তু ঈদের আনন্দ ঘরে আনতে পারেন না কেবল বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা৷ উল্টো, ঈদে তাদের নানা টেনশন বেড়ে যায়৷ সে টেনশনে মাথা-মগজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে৷ দুঃখ বলার জায়গা নেই৷ যারা শোনার কথা তারা সকলে বধির৷ শিক্ষক সমিতি বলি আর ফোরাম বলি সবাই যার যার অবস্থান থেকে একই কথা বলছেন৷ সকলেই জাতীয়করণের কথা বলছেন৷ সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা চাইছেন, ষোল আনা ঈদ বোনাস দাবি করছেন, বদলি ও পদোন্নতি কামনা করছেন, স্মারকলিপি দিচ্ছেন, সমাবেশ করছেন, অনশন করছেন৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা?

বেসরকারি শিক্ষকদের অবহেলার চোখে দেখার কারণে আমরা জাতি হিসেবে অবহেলিত-সে কথাটি আমাদের উপলব্ধিতে আসে না৷ আমাদের শিক্ষার মান কোথাও নেই-এর কারণটি আমরা খুঁজতে যাই না৷ বেসরকারি শিক্ষকদের যতই আমরা অবহেলা করি ততই আমাদের শিক্ষা অবহেলিত থেকে যায়৷ নোট গাইড,কোচিং বাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁসের দুর্নাম কেন আমাদের পেছন ছাড়ে না-সে বিষয়গুলো অনুসন্ধান করলে বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনার বিষয়টি সামনে চলে আসে৷

যে কোনো উৎসবে একটা বাজেট করা লাগে৷ আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়৷ রাষ্ট্র ব্যয় অনুসারে আয় করে৷ আর ব্যক্তি বা পরিবার আয় অনুযায়ী ব্যয় করে৷ আয়ের বাইরে গিয়ে ব্যয় করা যেমন সম্ভব হয় না তেমনি সমীচীনও নয়৷ করলে দেউলিয়া হতে হয়৷ আবার অনিবার্য অনেক ব্যয় আছে যে সব এড়িয়ে যাবার সুযোগ থাকে না, ব্যয় করতেই হয়৷ আয় না থাকা সত্ত্বেও যে ব্যয়টি অনিবার্যভাবে করা লাগে সে ক্ষেত্রে অবস্থাটি কেমন দাঁড়ায়-সে বিষয়টি আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা যদি ভেবে দেখতেন তাহলে বেসরকারি শিক্ষকদের দুর্গতি কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারতো৷

উৎসবে পার্বনে অনিবার্য অনেক ব্যয় করা লাগে৷ যেমন সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন এমনকি কোনো কোনো আত্মীয়-স্বজনের জন্যও নতুন নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে হয়৷ গরীব আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি ও হত দরিদ্র মিসকিনদের দান খয়রাত করতে হয়৷ আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত খাওয়ানো লাগে৷ তাদের বাড়ি বেড়াতে যেতে হয়৷ দূরে কোথাও দর্শনীয় বা পর্যটন এলাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে হয়৷৷ এসব ছাড়াও ঈদে আরও অনেক আনুষাঙ্গিক বিষয়-আশয় আছে যেখানে আর্থিক সঙ্গতি কিংবা অসঙ্গতির প্রশ্নটি থেকে যায়৷

ঈদুল আজহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব৷ সবচেয়ে খুশির দিন৷ এ ঈদে কোরবানী করা সব মুসলমানের ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকে৷ সামর্থ্য থাকুক কিংবা নাই থাকুক সবার ইচ্ছে থাকে কোরবানী দেবার৷ ইসলাম সবার জন্য কোরবানী অপরিহার্য না করলেও অনেকে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বে কোরবানী দিতে চান৷ অনেকে কোরবানী দেয়াকে ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা রক্ষার বিষয় হিসেবে গণ্য করে থাকেন৷

ঈদ আসতে না আসতে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের টেনশন বহুগুণে বেড়ে যায়৷ এমনিতে সারা বছর নানা টেনশন তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকে৷ টেনশনে টেনশনে দিন কাটে তাদের৷ টেনশনে মাথার চুল ক্ষয়ে যায়৷

যে ঈদ বোনাস তারা পান তা দিয়ে ঈদের বাজেট মেকাপ করা যায় না৷ ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ সামাজিক মর্যাদা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠে৷ সন্তানের ইচ্ছে পূরণ করা যায় না৷ আত্মীয় স্বজন ও পরিবার পরিজনের মন রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠে৷ ধর্মীয় কাজ যথাযথ পালন করতে না পারার টেনশন তাদের মনে কষ্টের পাহাড় রচনা করে৷

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অনেক করে সরকারকে ষোল আনা বোনাসটি দেবার কথা বলেছেন৷ অন্তত এ দফা সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি শিক্ষক সমাজ শতভাগ উৎসব বোনাস পাবার বিষয়ে শতভাগই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন৷ সরকারের দৃষ্টি তারা নানাভাবে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন৷ গতকাল না কোনদিন যেন একটি শিক্ষক সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবসহ জেলা সদরসমূহে প্রতীকী অনশন পালন করেছে৷ অন্যরাও অন্যভাবে দাবি জানিয়ে আসছে৷ একই দাবি সকলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে করতে পারলে আরও ভালো হতো৷

বেসরকারি শিক্ষকদের খণ্ডিত বোনাস দেয়াকে কেউ যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার সামিল মনে করে তবে তা ভুল হবে বলে মনে হয় না৷ 'ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেয়া' বলে একটি কথা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি৷ ঠিক এ মুহূর্তে বেসরকারি শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস দেবার বিষয়টিকে আমার কাছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বলে মনে হয়৷


 
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের খণ্ডিত ঈদ বোনাস দেবার বিষয়টি আমাদের দেশের বর্তমান আর্থিক সঙ্গতির সাথে একেবারে সামঞ্জস্যহীন ও বেমানান৷ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য লজ্জার কারণ৷ এক সময় আমাদের সামর্থ্য ছিল না৷ এখন সামর্থ্য হয়েছে৷ আমরা মধ্যম আয়ের দেশের সিঁড়িতে পা দিয়েছি৷ এর সাথে আমাদের মন মানসিকতারও পরিবর্তন অপরিহার্য৷ মনের দিক থেকে আমাদের নিজেদের অবস্থান বিবেচনা করতে হবে৷ ছোটবেলা দাদা-দাদীর মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম৷ সেটি এই- 'ধনী গরীব হলেও তার মন ধনী থেকে যায় আর গরীব ধনী হলেও তার মন গরীব থেকে যায়'৷ আমাদের তাই হয়েছে কিনা কে জানে? তা না হলে শিক্ষা ও শিক্ষকদের বেলায় আমরা এত কৃপণ কেন?

অবিলম্বে আসন্ন ঈদুল আজহার আগে বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ বোনাস দেবার ব্যবস্থা গ্রহণের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে আজকের লেখাটি এখানেই শেষ করতে চাই৷ আশা করি তা করে সরকার জাতীয়করণের পথে আরেক ধাপ অগ্রসর হবে৷ কর্তাব্যক্তিদের সে বোধোদয়টুকু জাগ্রত হউক৷ শিক্ষায় যত কলঙ্ক তিলক আছে সব একে একে ঘুচে যাক৷ এবার থেকেই বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদ হউক সকল প্রকার টেনশনমুক্ত৷ অন্তত ঈদগুলো টেনশনের ঊর্ধে থাকুক৷

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044748783111572