বেহাল শিক্ষা ক্ষেত্র, সংস্কার প্রয়োজন

ড. মো. জাকির হোসেন |

সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর উন্নত জাতিসমূহের উন্নতির পেছনে শিক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। এটা সমাজ বিজ্ঞানীদের মতামত। সাধারণ ভাষায় আমরা বুঝি, যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আমরা জেনে আসছি, শিক্ষা হলো অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো একটি মৌলিক অধিকার; এটা কোনো সুবিধা নয়। মানুষের এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সরকারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না।

এই সুযোগে মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছে কিছু সংখ্যক অসাধু শিক্ষা ব্যবসায়ী। যারা শিক্ষাকে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করে অসহায় মানুষদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।

আমাদের দেশ বর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অতি দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে উন্নয়ন আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে গুণগত উন্নতি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী দ্বিমত পোষণ করেন।

বিগত দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দুই জন শিক্ষার্থীর পাস করার তথ্যটি সচেতন মহলকে বেশ উদ্বিগ্ন করে। যদিও কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশের শিক্ষার হাল এ রকম ছিল না। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এ প্লাস ও এ গ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা রীতিমত আতকে ওঠার মতো।

কিছুদিন আগে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি জরিপ পরিচালনা করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল জিপিএ’র মানে কী? তারা বলতে পারেনি। এসএসসি’র মানেও বলতে পারেনি তারা। আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি ইংরেজি কী হবে? উত্তরে একজন বলেছিল: I am GPA five. এই যদি হয় শিক্ষার মান! তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হওয়ার মতো শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর হবে। 

যাক, কথা হচ্ছিল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে, ক্যামব্রিয়ানের মালিক জনৈক আবুল বাশার (লায়ন বাশার) তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন  Cambrian Education Group.  
তিনি নাকি সরকারি লাইসেন্সও নিয়েছেন? আমার প্রশ্ন, শিক্ষা কি এমনই একটি চালু বাণিজ্যিক পণ্য যে, গ্রুপ অব কোম্পানি করে শিক্ষা ব্যবসা করতে হবে। 

আর সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরেরই এমন কী দায় পড়ল যে, যিনি শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করবেন; আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন তাকে সুযোগ করে দিলেন। আর যারা শিক্ষাকে একটি মানবিক সহায়তা বিবেচনা করে সুবিধা বঞ্চিতদের বিনা মূল্যে শিক্ষা সুবিধা দিচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল তাদের প্রতি উদাসীন।
 
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর প্রতি অভিভাবকদের বেশি আগ্রহ। অধিক মুনাফার আশায়, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো নীতি নৈতিকতার বাছ-বিচার না করে যে কোনো চরিত্রের লেখা পড়া জানা বা সার্টিফিকেটধারী (সুশিক্ষিত নয়) মানুষদেরকে শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেয়ার কারণে আজ শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের অনৈতিক ঘটনা ঘটছে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে তথাকথিত শিক্ষকের দ্বারা নিজের প্রতিষ্ঠানের ৪০ শিক্ষার্থীর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এটা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয় পুরো শিক্ষক সমাজের জন্য লজ্জার। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষকতার মহান আদর্শ ও উদার চেতনাকে ভুলুন্ঠিত করেছে। এ ঘটনার দায় প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে অবশ্যই নিতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান এ ঘটনা জানেন না বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমি নিজে একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, আমার প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের ছোট বড় সকল ঘটনা আমার নখদর্পণে থাকে।

আর সত্যি যদি তিনি না জানেন তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোনো যোগ্যতা তার নাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধু ডিগ্রি এবং অভিজ্ঞতা ছাড়াও বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয় যা তার নেই। 

শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের  অনৈতিক ও অমানবিক ঘটনা রোধে আমার কয়েকটি পরামর্শঃ 

১. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রোধে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানা শিক্ষা অফিসার ও থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দিতে হবে যেন তারা পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ না পায়।

২. দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ধরনের বা অভিন্ন সিলেবাসে লেখাপড়ার সুযোগ থাকবে। একই দিনে সারাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ব নির্ধারিত তারিখে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কোনো বিদ্যালয় সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হবে না। তবে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য একই সিলেবাসের ইংরেজি ভার্সন থাকবে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে ফলাফলের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ সুবিধা পাবে না।

৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সব রকম প্রাইভেট ও কোচিং পড়ানো আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কোচিং পড়ানো জরুরি হলে সংশ্লিষ্ট থানা শিক্ষা অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বে পরিচালিত হবে।

৪. শিক্ষকতা পেশায় জড়িত নন এমন ব্যক্তি প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং পড়াতে পারবেন না।

৫. পাড়ায় মহল্লায় যেখানে সেখানে প্রাইভেট বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। প্রতিষ্ঠার পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে।

৬. কোনো ব্যবসায়ী শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অবশ্যই একজন শিক্ষক, সমাজ সেবক অথবা সুশীল সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ হবেন। কোনো ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব ট্রাস্টের ট্রাস্টিদের হাতে থাকবে না, সরকার কর্তৃক নিয়োজিত বিশেষ কমিটির হাতে থাকবে। 

৭. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে কেউ যেন আর্থিকভাবে লাভবান হতে না পারে এ জন্য প্রতি বছরের আর্থিক লেন-দেনের হিসাব সরকারি দপ্তরে জমা দিয়ে অনুমোদন করাতে হবে। আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়লে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।

৮. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির একক কর্তৃত্ব থাকবে না। প্রয়োজনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি করে যোগ্যতম প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে।

৯. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা নয়; বরং তার নৈতিক চরিত্র, আচার আচরণ, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। 

১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে সামাজিক দুর্বৃত্ত, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী প্রভাবশালীদের অংশ গ্রহণ করতে না দিয়ে শিক্ষিত, নৈতিক আদর্শবান ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত ও সরকারি কর্মকর্তাদের রাখতে হবে।

১১. শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সাথে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে মসজিদে ও মন্দিরে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১২. কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে নৈতিক অবক্ষয়ের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তাকে বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে হবে এবং নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কর্মস্থলে আসতে পারবে না ।

এই সমস্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, পুলিশ বাহিনী, সমাজ সেবা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, এলাকায় অবস্থিত সরকারি স্কুল বা কলেজের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষকে নিয়ে প্রতি থানায় সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে। সংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুসারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

লেখক: অধ্যক্ষ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031099319458008