বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ জরুরি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিচ্যুতিমূলক আচরণের পেছনে তাদের নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজন এবং তা পূরণের ব্যর্থতা অনেকাংশে দায়ী। আর এর জন্য দরকার সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ। মনে করা হয় সামাজিক নির্দেশনা ও পরামর্শ শুধু সমাজে বিরাজমান সামাজিক সমস্যা নিরসনের জন্য নয় বরং কোমলমতি ছেলেমেয়েদের পরিপকস্ফতা অর্জন, উন্নত অভ্যাস গঠন, প্রত্যাশিত দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ, কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ এবং সঠিক ও মানসম্মত মূল্যবোধ আয়ত্ত করার জন্যও প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। বৃহস্পতিবার (২৫ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আধুনিকায়ন ও নতুন প্রযুক্তির এই যুগে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের সামাজিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হচ্ছে। সনাতন পরিবার কাঠামো ও পরিবারের ভূমিকার মধ্যে পরিবর্তন পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধনের মধ্যে শৈথিল্য সৃষ্টি করছে। ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবকদের অযত্ন ও অবহেলা এবং যথাযথ ভূমিকা পালনের গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতা আমাদের আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন মানুষের যতগুলো ভালো গুণ যেমন- সততা, সহযোগিতা, সাহস, মহানুভবতা, দয়ালু এবং নিজের অবস্থান সম্পর্কে অনুভূতি কিংবা পরিপূর্ণ ধারণা থাকতে হয়, যা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; কিন্তু উপযুক্ত পরিবারের অভাব ছেলেমেয়েদের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলির বিকাশে বাধা হয়ে কাজ করছে এবং তাদের মধ্যে অসামঞ্জস্য মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে।

সাধারণত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিবিধ সামাজিক প্রয়োজন থাকে, যার মধ্যে তাদের বিকাশ ও কল্যাণ নিহিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা, স্নেহ, স্বীকৃতি, সাহায্য, মর্যাদা এবং সর্বোপরি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। শিক্ষার্থীদের এ চাহিদা বা প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য আর্থিক প্রণোদনা যতটা না গুরুত্ব বহন করে, তারচেয়ে ঢের বেশি কাজ করে সামাজিক নিদের্শনা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। মোটকথা তাদের সামাজিক পরিবেশে মানুষ হতে দেওয়া। সমাজ যদি তাদের প্রয়োজন পূরণে বাধা সৃষ্টি না করে এবং একটি উন্নত ও মানসম্মত পথ অনুসরণ করে, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। তারা বিচ্যুতমূলক আচরণ পরিহার করে।

চাহিদা পূরণে বাধা এবং বৈধ পথ না থাকা তাদের জন্য কখনও কখনও কাল হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীদের আরও কতকগুলো চাহিদা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সবসময় চায় তাদের কাজের স্বীকৃতি ও অন্যদের কাছ থেকে স্নেহ ও ভালোবাসা। এটি তাদের কাছে বড় বিষয়। এরা হতে পারে পরিবারের বাবা-মা, বড় ভাইবোন, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। যখন উল্লিখিত কাছের মানুষ দ্বারা এ চাহিদাগুলো পূরণ হয়, তখন তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং সমাজ তাদের যে গ্রহণ করেছে এমন অনুভূতি কাজ করে। এটি মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সহজাত। এতে করে তাদের ভেতরকার সুপ্ত অবস্থায় থাকা সামর্থ্য ও অনুভূতি বৃদ্ধি ও বিকশিত হয়।

একমাত্র সৌহাদ্যপূর্ণ আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক তৈরিতে একজন তখনই সামর্থ্যবান হয়ে ওঠে, যখন সে অন্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়ে থাকে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বিকল্প হিসেবে তাদের প্রত্যাশিত সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন দলে অংশগ্রহণ ও এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিকাশ ঘটাতে চায়। তারা মূলত দলীয় গতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে একত্রে থাকতে পছন্দ করে। তারা তাদের বন্ধুদের কাছ থেকেও গ্রহণযোগ্যতা পেতে চায়। যদি একজন শিক্ষার্থী কোনো দলের সদস্য না হয়, তাহলে তার জীবন বিকাশ অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং তার মধ্যে একাকিত্ব কাজ করে। সাহচর্যের ঘাটতি নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে নিজেই প্রশ্ন তোলে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যখন শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে থাকে, তখন তাদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সমস্যা সমাধানে অপারগতা তৈরি হয়। নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সামর্থ্য বিকাশের জন্য তাদের অবশ্যই শিক্ষাবহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা চাই। ভিন্নতায় শিক্ষার্থীদের বিকাশ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়।

আগেকার সমাজের তুলনায় বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন। সমাজের দ্রুত পরিবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশভঙ্গির কারণে চাহিদারও পরিবর্তন হচ্ছে। নিত্যনতুন বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রবলভাবে কাজ করে। প্রযুক্তি এক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করছে। সনাতন বিনোদন মাধ্যম ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পরিবর্তে এখন আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় একদিকে এর সহজলভ্যতা অন্যদিকে ধরনের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার সময় ও বিশ্বকে আজ কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। প্রযুক্তির বিকাশ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। আর্থিক বলি কিংবা সম্মান ও মর্যাদার কথা বলি প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছি। প্রতিযোগিতার মধ্যে শিশুরা বেড়ে উঠলে বিকাশ ভালো হয় সত্য; কিন্তু সর্বত্র প্রতিযোগিতা অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তি আমাদের সনাতন বিশ্বাস ও মূল্যবোধেও চিড় ধরেছে। আমরা এখন অনেকটা বৈষয়িক হতে চলছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এর প্রভার পরিলক্ষিত। সামাজিক পরিবর্তন ও প্রযুক্তির প্রসার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশকেও প্রভাবান্বিত করছে।

ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতিও ভিন্ন। কেননা শিক্ষার্থীরা ভিন্ন পরিবার ও সংস্কৃতিতে বড় হয়। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতেও এই ভিন্নতা কাজ করে। মূল কাজ সবকিছুর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান। এমনভাবে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শ জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিকল্প হিসেবে নির্দেশনা ও পরামর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজ থেকে সঠিক নির্দেশনা তাদের সঠিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যে রাখতে পারে। এতে লাভ হলো সঠিক পথে থাকা এবং ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে তিরস্কার করা।

 

লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034151077270508