আমরা যারা ইসলামকে ভালোবাসি, ইসলামের বিধি-বিধান পালন করতে চেষ্টা করি আমাদের মনে অনেক দুঃখ, অনেক বেদনা। কয়েক যুগ যাবত প্রিয় মাতৃভূমিতে আমরা চরম বৈষম্যের শিকার। ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আমরা নিগৃহীত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত। আমাদের দুঃখ-বেদনার অনুসঙ্গ অনেক। সেগুলো থেকে দু’চারটি উল্লেখ না করে পারছি না। বিগত বছরগুলোতে হক কথা বললে আমাদেরকে ট্যাগ লাগানো হত ‘জঙ্গি’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, ‘উগ্রবাদী’, ‘মৌলবাদী’ বলে। চেতনার নামে চাপিয়ে দেয়া শিরক, কুফর, পাপাচার, অশ্লীলতায় জড়াতে না চাইলেই আমাদের নিন্দা করা হতো ‘সেকেলে ও ‘ধর্মান্ধ’ বলে। আমাদের ব্যাগে, অফিসে বা ঘরে ইসলামি বই পাওয়া গেলে ‘জিহাদি বই পাওয়া গেছে’, ‘জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার আলামত পাওয়া গেছে’ ইত্যাদি বলে মিডিয়ায় কভারেজ করা হতো। গ্রেফতার করে জুলুম করা হতো। আমাদের মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপে ইসলামি লেকচার, আর্টিকেল, বই-পুস্তক ডাউনলোড করে রাখার সাহস আমরা পেতাম না। ফেসবুকে সত্য কথা লেখার সাহস করতাম না। আমরা টেনশনে থাকতাম কখন না জানি আমাদের ব্যবহারের এসব ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তল্লাশি করে ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের সঙ্গে আমাদের কানেকশন’ আবিষ্কার করে আমাদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। মসজিদে আমাদের জন্য খুতবার আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করে দেয়া হতো এমন ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যারা খুতবা কী, কেনো দেয়া হয়, কীভাবে দিতে হয়, কী কী বলতে হয় তার বিন্দুমাত্র জানেন না।
ওয়াজ মাহফিলে বেনামাজি, সুদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, চাঁদাবাজ, লম্পট, বদমাশকে সভাপতি না করা হলে সেই ওয়াজ মাহফিল করতে দেয়া হতো না। নিজেদের ঘরে বা কোনো হলরুম ভাড়া করে ইসলামি জলসা করলে ‘জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিলো’ বলে আমাদেরকে রঙ দেয়া হতো, গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হতো। ঘরে বাইরে আমাদের প্রতি অযথাই গোয়েন্দা নজরদারি করা হতো। এতো এতো অনুষঙ্গের কারণ একটাই। তা হচ্ছে আমরা ইসলামের বিধি-বিধান পালন করতে চেষ্টা করি। মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচার হাসিনা, তার মন্ত্রী-এমপি, তাদের নেতা-কর্মী দোসর এবং তাদের পালিত রাষ্ট্রীয় পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের দৃষ্টিতে আমাদের অপরাধ একটাই। সেই অপরাধটি হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) এর আদর্শের অনুসরণ।
আমাদের প্রতি যে আচরণ করা হতো তাতে আমাদের বলা উচিত ছিলো, ‘আমরা নির্যাতিত সংখ্যালঘু। আমরা বৈষম্যের শিকার। আমাদের প্রতি অত্যাচার করা হচ্ছে।’ প্রসঙ্গত বলতে হয়, কয়েকদিন যাবৎ এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক নিজেদেরকে সংখ্যালঘু ঘোষণা করে নাটক সাজিয়ে বলছে, ‘আমাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে।’ ‘দেশছাড়া করা হচ্ছে’। এমনকি উক্ত সম্প্রদায়ের অনেক লোক একটি সীমান্ত এলাকায় গিয়ে পানিতে নেমে বসে আছে আর বলছে ‘আমাদেরকে এই এই দাবি মানা না হলে, অমুক অমুক বিশেষ সুযোগ-সুবিধা না দিলে আমরা পানি থেকে উঠবো না।’ ওইসব ধান্দাবাজদের মতো কাজ আমরা করিনি। অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ সহ্য করে আমরা আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছি, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এই জনপদ থেকে জালিম সরকারকে হটিয়ে দিন। আমাদেরকে রক্ষা করুন, আমাদের ঈমান, আমল, জান-মাল, উজ্জত আব্রু রক্ষা করুন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করুন। জেল-জুলুমের শিকার, আয়নাঘরে বন্দি আমাদের নিরাপরাধ ভাইবোনদেরকে আপনি হেফাজত করুন। তাদেরকে মুক্ত আলোতে জীবনযাপনের সুযোগ করে দিন।’ অবশেষে আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা প্রেরণ করলেন কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী নামক এই নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ফলে হাসিনা সরকার লেজ গুটিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেলো। আর আমরা লাভ করলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা। অর্জিত হলো দ্বিতীয় বিজয়।
এবার আমি আমাদের দুঃখ-বেদনার সবচেয়ে বড় কারণটির কথা বলছি। আর তা হলো ইসলামি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ-বেদনা। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে ইসলামি শিক্ষা দিতে না পারার দুঃখ-বেদনা। আমরা সবচেয়ে কষ্টে আছি বিগত ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের ইসলামি শিক্ষা সংকোচনের কারণে। নব্বইর দশকে এদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষার ভালো অবস্থা ছিলো। তখন স্কুলে ১০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিলো। বইয়ের মান এবং পাঠ্য বিষয় ছিলো সন্তোষজনক। কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা ছিলো ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। তবে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের ছাত্রছাত্রীরা এই বিষয়টি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নিতে পারতেন। তখন বিষয়টির মান ছিলো তৃতীয় বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি, অনার্স এবং মাস্টার্সে ইসলামি শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হতো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টি যেমন পড়নো হতো গুরুত্বের সঙ্গে তেমনি বড় বড় কলেজে ইসলামি শিক্ষা বিষয়টির অবস্থান ছিলো প্রথম দিকে। নব্বইর দশকের পর আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসলো তখন থেকে বিভিন্ন অপকৌশলে ইসলামি শিক্ষাকে সংকোচনের অপচেষ্টা শুরু হয়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষাকে কোণঠাসা করা হলো। এখনো সেই অবস্থা বিরাজ করছে। এখন বাংলাদেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে সাতটি বা আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষা সাবজেক্টটি পড়ানো হয়। তাও বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। উচ্চ মাধ্যমিকে ‘ইসলাম শিক্ষা’ শিরোনামের সাবজেক্টটিকে স্লো পয়জন দিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে গত দুই যুগ ধরে। আইনের মারপ্যাঁচে এমনভাবে শিক্ষাক্রম সাজানো হয়েছে যাতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে সাবজেক্টটি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শিক্ষাক্রমে ২০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা রাখা হলেও সাবজেক্টটিকে করা হয়েছে চতুর্থ বিষয়। আগে সব শাখার শিক্ষার্থীরা এই বিষয়টি পড়তে পারতেন। এখন কেবল মানবিক শাখার ছাত্রছাত্রীরা এটি পড়তে পারে। তা আবার ইসলাম শিক্ষা সাবজেক্টকে এমন ক্লাস্টারে ফেলা হয়েছে যেনো এই সাবজেক্ট পড়লে এই ক্লাস্টারের অন্যান্য সাবজেক্টের তুলনায় শিক্ষার্থীরা রেজাল্টে পিছিয়ে পড়ে। সে কারণে এখন এই সাবজেক্টে শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা এই সাবজেক্ট নিতে চায় না রেজাল্ট খারাপ হওয়ার আশঙ্কায়। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হচ্ছে নতুন কারিকুলামে উচ্চ মাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষার কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। এ থেকে অনুমান করা যায়, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়িত হলে উচ্চ মাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষা সাবজেক্ট থাকবে না।
এবার আসি স্কুলে ‘ইসলাম শিক্ষা’ শিরোনামের সাবজেক্ট এর কথায়। স্কুল লেভেলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০০ নম্বরের ‘ইসলাম শিক্ষা’ নামক একটি সাবজেক্ট আছে যুগ যুগ ধরে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে স্কুল লেভেলের ইসলাম শিক্ষায় হাত দেয়নি। তখন কেবল কারিকুলাম পরিবর্তন করে আওয়ামীপন্থি লেখকদের দ্বারা বইটাকে নতুন করে লেখানো হয়েছে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ইসলামবিদ্বেষী আওয়ামী সরকার স্কুলের কারিকুলাম থেকে ইসলাম শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের নতুন কারিকুলামে ইসলাম শিক্ষা সাবজেক্টকে রাখা হয়নি। তখন ইসলাম শিক্ষার সম্মানিত শিক্ষকরা এবং ইসলামপ্রেমী নাগরিকরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছেন। সভা-সেমিনার করেছেন। সভা-সেমিনার করার অপরাধে শত শত শিক্ষক জেল খেটেছেন। হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন। অবশেষে ইসলাম শিক্ষার সম্মানিত শিক্ষকরা, উলামা-মাশায়েখ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায় এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার উদারপন্থী কতিপয় লোকের হস্তক্ষেপে বিষয়টি পুনর্বহাল করা হলো এবং সাবজেক্টটির নাম বা শিরোনাম দেয়া হলো ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’। কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হলো। আওয়ামীন্থি লেখকদের দ্বারা বই লেখানো হলো। বইয়ের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিলো। তারপরও ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ নামক একটা সাবজেক্ট চালু ছিলো এবং ১০০ নম্বরের বোর্ড পরীক্ষা হতো এই সাবজেক্টের ওপর। এই সাবজেক্টের জন্য সপ্তাহে পিরিয়ড ছিলো তিনটি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে নতুন কারিকুলাম চালু করা হলো। এবার বইয়ের নাম পরিবর্তন করা হলো। বইয়ের নাম রাখা হলো ‘ইসলাম শিক্ষা’। কিন্তু এবার শুরু হলো আরেক ষড়যন্ত্র। এবার বলা হলো, ইসলাম শিক্ষা সাবজেক্ট কেবল স্কুলে পড়ানো হবে। এ সাবজেক্টের বোর্ড পরীক্ষা হবে না। ইসলাম শিক্ষার জন্য সাপ্তাহিক পিরিয়ড করা হলো তিনটির স্থলে দুইটি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ইসলাম শিক্ষার প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ঠ সংখ্যক পাঠ থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি ইসলাম শিক্ষার অনেক শিক্ষককে হয়তো অন্য সাবজেক্ট পড়াতে হচ্ছে, নয়তো তারা চাকরিচ্যুত হচ্ছেন।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে, শত শত জীবনের বিনিময়ে, অঙ্গহানি ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে, অনেক রক্তের বিনিময়ে এবং আল্লাহভীরু উলামা-মাশায়েখ ও আমজনতার দীর্ঘদিনের দোয়া-মুনাজাত ও কান্নাকাটির ফলে আজ অর্জিত হয়েছে আমাদের কাঙ্খিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা। গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই সরকার ইসলামপ্রেমী সরকার। তার প্রমাণ আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখতেও পাচ্ছি। বর্তমান অন্তরবর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়কে আওয়ামী দখলদারদের থেকে মুক্ত করে মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য টুপি ও হিজাব আবশ্যিক করা হয়েছে। এসব প্রশংসনীয় পদক্ষেপের মত ইসলাম শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্য জালিম সরকার তৈরি করেছিলো তার অবসান ঘটিয়ে ইসলাম শিক্ষাকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে স্কুলের সকল শ্রেণিতে ইসলাম শিক্ষার সাপ্তাহিক পিরিয়ড দুইটির স্থলে তিনটি করা এবং বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় ইসলাম শিক্ষাকে পুনর্বহাল করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন পেশ করছি। জোরালো দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শ্রেণিতে ইসলাম শিক্ষাকে নব্বইয়ের দশকের পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিনীত আবেদন জানাচ্ছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা