ব্রিটেন থেকে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে লড়ছেন বাংলাদেশী শেফ সাইফুল

অহিদুজ্জামান, লন্ডন থেকে |

মানবতা-মানবাধিকার-গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উচ্চকিত মূল্যবোধের ব্রিটেনে ন্যায়বিচার বঞ্চিত সাইফুল ইসলাম নিঃস্ব হয়ে প্রায় ১৬ বছর ধরে ঘুরছেন বিচারের আশায়। প্রশ্ন উঠেছে তিনি কী আদৌ ন্যায় বিচার পাবেন? 

বাংলাদেশ থেকে ২০০৩ সালে সাইফুল একজন দক্ষ পাচক হিসাবে হাইস্কিলড ভিসায় যুক্তরাজ্যে এসেছেন উন্নত জীবনের আশায়। তিনি ২০০৩ সাল থেকে পাঁচ বছর পাচক হিসাবেই যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রেস্তোঁরায়  কাজ করেছেন। কিন্তু সাইফুল ইসলাম প্রথম যেই রেস্তোঁরার মালিকের অধীনে এসেছিলেন সেই মালিক চুক্তি মোতাবেক বেতন-ভাতা এবং টেক্স-ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স পরিশোধ না করে তাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে পেটে-ভাতে খাটিয়েছেন। একপর্যায়ে তিনি এই নিবর্তনের প্রতিবাদ করলে তাঁকে  শারীরিক নির্যাতন করে রেস্তোঁরার মালিক। এই বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করলে ওই মালিক হোম অফিসে আবেদন করে মি.সাইফুলের ভিসা বাতিল করে দেয়।দ্বিতীয় দফায় তিনি অন্য এক মালিকের অধীনে কাজের জন্য অনুমতি চাইলে হোম অফিস তাঁকে দ্বিতীয় দফায় ১৮ মাসের জন্য কাজের অনুমতি সহ ভিসা মঞ্জুর করে। তিনি দ্বিতীয় মালিকের অধীনে কাজ শুরু করার কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয় একই নিবর্তন। এভাবে এক অসহনীয় দুর্ভোগের মাঝেই তাঁর অতিবাহিত হয় পাঁচ বছর। তিনি তৃতীয় এক মালিকের অধীনে পূনরায় ভিসার আবেদন করলে হোম অফিস কোনো জবাব না দিয়ে তাঁর পাসপোর্ট আটকে রাখে। 

এরমধ্যেই যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর পর স্থায়ী বসবাসের জন্য তিনি আবেদন করলে তাঁর আবেদন নাকচ করে দেয় হোম অফিস।কারণ হিসাবে জানায় তিনি নিয়মিত কাজ করেন নি।মূলত হোম অফিসে পাসপোর্ট আটকে থাকার কারণেই তিনি তৃতীয় মালিকের কাজ করতে সক্ষম হননি বলে মি. সাইফুল এই প্রতিবেককে জানিয়েছেন।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়।হোম অফিস তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট যৌন অপরাধসহ একাধিক অভিযোগ এনে তা গোপন রাখে এবং তাঁকে ডিপোর্টেশনের চেষ্টা চালায় বলে তিনি জানান।এর এক পর্যায় একজন স্বেচ্ছাসেবী আইনজীবীর পরামর্শে তথ্যঅধিকার আইনের আওতায় তথ্য কমিশনের মাধ্যমে হোম অফিসের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবগত হন এবং এবিষয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ করলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এতে হোম অফিস মি. সাইফুলকে ৫ হাজার পাউন্ড ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব দেয়। তিনি এই প্রস্তাব নাকচ করে তাঁর সম্পূর্ণ ন্যয্য অধিকার দাবী করেন।

তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আদালতেও আমি ন্যায় বিচার পায়নি। উন্নত জীবনের আশায় যুক্তরাজ্যে এসে আমার জীবনের প্রায় দেড় যুগ কেটে গেছে চরম এক দুর্যোগপূর্ণ ও হতাশায়। এখানে আমার সময়ে কেটেছে অর্ধাহারে-অনাহারে-নিবর্তনে। এখন আমি নানা ক্রনিক রোগে ভুগছি। কে ফিরিয়ে দেবে আমার জীবনের মূল্যবান ১৭ বছর? কোথায় গেলে এই নির্যাতনের বিচার পাবো- তা আমি জানি না।''

যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৩৫-৪০ ঘন্টা কাজ করার নিয়ম থাকলেও ইন্ডিয়ান রেস্তোঁরার মালিকরা একজন কর্মচারীকে দিয়ে দৈনিক ১৫-১৮ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করেন। এমনকি শারীরিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুধ্যে। এমনকি যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী রেস্তোঁরার মালিকরা ন্যূনতম বেতন দেন না তা সকলেই জানেন। আর যদি মি.সাইফুলের মতো চুক্তি ভিসায় রেস্তোঁরায় কাজের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যে কেউ আসেন তা হলে এই নির্যাতন সহ্য করেই ক্রীতদাসের ভাগ্য মেনে নিতে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে- এটাই নিয়তি।প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে পুলিশ কি করেন? নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, পুলিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ জাতীয় ঘটনা এড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার আমলে নিলেও মালিককে শুধুমাত্র সতর্ক করেই ছেড়ে দেয়। মালিক বরং পুলিশকে নালিশের কারণে অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। এসব কথা বলছেন সাইফুল ইসলামসহ আরো অনেক ভুক্তভোগী।

এদিকে একজন ভুক্তভোগী তাঁর দেশ থেকে ব্রিটেনে আসেন ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে। তাঁর একমাত্র চাওয়া ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর ভালো রোজগার।এই আসায় সে সব কিছুই নীরবে সহ্য করে যান। মি. সাইফুলের ভাগ্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।তিনি আরো বলেন, তিনি সবচেয়ে নিঠুরতা এবং নিবর্তনের শিকার হয়েছেন হোম অফিস থেকে।কারণ, তাঁর সব কিছু বিবেচনায় না নিয়ে তাঁর আবেদন নাকচ করে দিয়েছে এবং তাঁকে গোপনে গোপনে একজন ভয়ংকর অপরাধী বানিয়ে এদেশ থেকে বিতরণের পাঁয়তারা করেছে।এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে? এমন প্রশ্ন করেন মি.সাইফুল। তাঁর এই হৃদয়ে বিদারক ঘটনা ব্রিটেনের মূলধারার প্রভাব শালী সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, দৈনিক গার্ডিয়ান ও স্কাই নিউজসহ বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশ হলে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

সাইফুল ইসলাম বলেন, ''পরাজয়ে ডরে না বাঙালি- এই মন্ত্র মনে গেঁথে লন্ডনের রাজপথে একাই নেমেছি প্রতিবাদ করতে।আজ হাউজ কমন্সের সামনে, কাল প্রধান মন্ত্রীর বাড়ি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে, পরের দিন সুপ্রিম কোর্টের সামনে। এভাবেই ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাবো যত দিন দেহে প্রাণ আছে।''

একটা হ্যান্ড মাইক হাতে আর ঐতিহ্যবাহি শেফের পোশাক পরে তিনি তাঁর নিজ বাসভূমি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ার আঞ্চলিক ভাষায়, কখনো অনর্গল ইংলিশ ভাষায় তাঁর অধিকার ফিরে চাচ্ছেন। এতে মূলধারার মানুষেরও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যেই প্রিন্স চার্লস, একাধিক হাউজ অব কমন্স সদস্য, ওয়েলস গভর্মেন্ট'র ফাস্ট মিনিস্টারসহ আরো অনেকেই তাকে লিখিত পত্র দিয়ে তাদের সহানুভূতির কথা জানিয়েছেন বলে জানান সাইফুল।  

সাইফুল ইসলাম আরো বলেন,''আমি ঢাকার বিভিন্ন নামি-দামি রেস্তোঁরায় শেফ হিসাবে কাজ করে একজন দক্ষ সেফ হিসাবে যুক্তরাজ্যে এসেছি। প্রথম ভিসার জন্য আবেদন করার পর ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাই কমিশন আমার কর্মস্থলে তদন্ত করে সন্তুষ্ট হয়েই ভিসা মঞ্জুর করেছে।''

অভিবাসী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাইফুল ইসলাম মানব পাচারের শিকার। তিনি নিজ দেশে বেশ ভালোই আয় রোজগার করতেন। তিনি একজন দক্ষ সেফ। তাঁকে উন্নত জীবনের আসা দিয়ে এদেশে এনে ক্রীতদাস হিসাবে বন্দি করতে চেয়েছিলো। 

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি বলছে, যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার মানুষ পানৰ পাচারের শিকার হয়ে ক্রীতদাসের জীবন-যাপন করছে।বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ৪০ মিলিয়নের বেশি মানুষ নানা প্রলোভনের ফাঁদে পাচার হচ্ছে।এর অধিকাংশই উন্নত দেশে হোটেল, রেস্তোঁরা, কৃষি খামার, পতিতালয়, নেইল পালিশ বার, মদের বারসহ নানা প্রতিষ্ঠানে শুধু পেটে-ভাতে খেয়ে শ্রম বিক্রি করছে। এর মধ্যে নারী-শিশুরাও রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032260417938232