ব্লু-ইকোনমি অভাবনীয় এক সম্ভাবনা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

কলম্বাস থেকে শুরু করে অনেকেই সমুদ্রের বুকে নিশান টানিয়ে আবিস্কারের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমাজনিত বিষয় মীমাংসা হওয়ার পর বেড়ে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিধি। অন্যসব দেশের মতো আমাদের চিন্তা-ভাবনাও আবর্তিত হচ্ছে, কিভাবে সমুদ্র থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা যায়। নীল জলরাশির মাঝে যে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে, তা অনেকের কাছেই বহু বছর ধরে অজানা ছিল। এই সমুদ্রকে ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের সীমা নেই। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে মানুষ আজ বুঝতে শিখেছে সমুদ্র মূল্যবান সম্পদে পরিপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে অপরিসীম-মানুষ আজ তা জেনে গেছে। 

প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মোকাবিলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন লস অব দ্য সিস (ইটলস) এবং হেগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে ২০১২ ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার ইটলসের ঐতিহাসিক রায় তাদের পক্ষে নিতে পারেননি । ভারত, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে সমুদ্রসীমার ভাগ-বাটোয়ারা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয়। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশেরে এখন সার্বভৌম অধিকার।

এই ঐতিহাসিক বিজয় বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের একটি বিশাল এলাকার সমুদ্র সম্পদ আহরণের অবারিত সুযোগও এনে দেয়। বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তন যেখানে মাত্র ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সামান্য বেশি, সেখানে সমুদ্রসীমার ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন আমাদের আনন্দের ও গৌরবের। দুঃখজনক বিষয় হলো, এই বিজয় অর্জনের এক দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও যথাযথ অগ্রাধিকার দিয়ে আজও এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করা  সম্ভব হয়নি। 

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, মাত্র ৪টি ব্লককে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু একটি কূপও বাংলাদেশ খনন করতে পারেনি। বাকি ২২টি ব্লক স্থবির হয়ে পড়ে আছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে উৎপাদন ও ভাগাভাগি চুক্তির আগে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে হবে কী হবে না-সেই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই আমরা এখনো আটকে আছি। 

মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টি এবং ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব।  ব্লু-ইকোনমি বর্তমানে বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ক্রমেই স্থলভাগের সম্পদের চেয়ে সমুদ্রের জলরাশির নিচে ডুবে থাকা সম্পদের দিকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর চোখ পড়েছে। সত্যিকার অর্থেই সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের ন্যায্যতা  এবং তার সঠিক ব্যবহারের ওপরই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ভর করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করা পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিজমির বাইরে খাদ্যের জন্য মানুষ অনেক আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। 

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্র অংশে কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ এবং অন্যান্য কী ধরণের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা কর্তৃপক্ষ যাচাই করছে। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটি বড় অংশই সমুদ্র থেকে আসে। সেই সঙ্গে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাও সমুদ্রের ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। বহু বছর ধরেই এসব জনগোষ্ঠী নৌকা ট্রলারে মাছ ধরে, জাল বুনে, মুক্তা ও চিংড়ি চাষ করে, লবণ শিল্প গড়ে তুলে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।

সমুদ্র অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া যায়, তা হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। আর অস্ট্রেলিয়া বছরে সমুদ্রসম্পদ থেকে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সেভ আওয়ার সি'র তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। শুধু সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে। 

উপকূলীয় দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক সমুদ্রবাণিজ্যের মাধ্যমে সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে, বাংলাদেশের কক্সবাজারের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা বিবেচনার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দর এবং পায়রা বন্দরকে শক্তিশালী ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। মালামাল পরিবহনের জন্য নৌ-পরিবহন খাতই সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত, সবচেয়ে নিরাপদ, সর্বোচ্চ দক্ষ এবং সর্বাধিক পরিবেশ বান্ধব। কেননা এই খাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে,  সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কমেছে, টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইমের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। সাগরে কিংবা বাতাসে বর্জ্য নিষ্কাশনের মাত্রা  হ্রাস পেয়েছে । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিরাজমান সুবিধা সংস্কারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর একটি আঞ্চলিক প্রাণকেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে। বিশ্ববাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে, বাংলাদেশকে যদি চীন বা তার মতো বৃহৎ অর্থনীতি থেকে লাভবান হতে হয়-তা হলে চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দকে আরও আধুনিকায়ন করে এগুলোকে গমন পথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশিরভাগই সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়, যা দেশের মোট  বহির্বাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিপুল পরিমাণ মালামাল-শুল্ক দেশের অভ্যন্তরে রাখার উদ্দেশ্যে স্থানীয় শিপিং কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। যাতে করে তারা বিদ্যমান জাহাজ বহরের সঙ্গে আরও জাহাজ সংযুক্ত করতে পারে। এছাড়া, সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, যাত্রীবাহী খেয়া পারাপার সেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহন, জাহাজ প্রস্তুতকরণ এবং জাহাজ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পগুলো আমাদের দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও গুরুত্ব বহন করতে পারে। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বন্দর স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি বার্মা, চীনকে  এটি নিশ্চিত করতে হবে। নিকট প্রতিবেশি ভারতও চাইছে তার উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি অঙ্গরাষ্ট্রে পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করতে। এর ফলে তাদের সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় ঘটবে। এভাবে প্রতিবেশি দেশগুলোকে বন্দর-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। সমুদ্র বিজয়ের ফলে বাংলাদেশ যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন শিল্পের আধুনিকায়ন করতে পারলে ২০৩০  নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব।  

ব্ল-ইকোনমি ক্রমেই প্রতিটি দেশের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র ও তেলক্ষেত্র থেকে। স্থলভাগে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। বিশ্বের সব দেশের নজর এখন সমুদ্রের দিকে। তাই সমুদ্র এলাকায় গ্যাসের মজুদ চিহ্নিতপূর্বক গ্যাস আহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে, যদিও প্রযুক্তি এখনো আমাদের প্রধান বাধা। স্থল এবং আকাশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্রে সক্ষমতা প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে প্রায় সকল দেশ এবং নিজ সামুদ্রিক সীমানা দখলে রাখতে মোটা অঙ্কের বাজেট তৈরি করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ গড়তে সমুদ্রকে গুরুত্ব দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে সমুদ্র অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার ।কারণ, সমুদ্র বিজয়ের পর সেই দুয়ার এখন বাংলাদেশের সামনে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।খুলে দিয়েছে অফুরান সম্ভাবনার এক বিশালতা।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গ্যাসের প্রকৃত পরিমাণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান করে সমুদের তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমা রয়েছে, যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সমান। এসব তথ্য বিবেচনায় নিলে অনুধাবন করা সম্ভব, সত্যিকার অর্থেই আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটতে যাচ্ছে।  

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় আরও গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের গ্যাসের মোট মজুতের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে। বঙ্গোপসাগরে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ পাওয়া যাচ্ছে। এসব সম্পদ সঠিক উপায়ে উত্তোলন করতে পারলে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। 

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলে প্রায় ৭০ হাজার যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানের সহায়তায় জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা পড়লেও আমাদের জেলেরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে আমাদের মাছ আহরণ আরো বাড়বে। মৎস্য সম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণি, সামুদ্রিক আগাছা, লতাগুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। মাছ থেকে খাবার, মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, সস তৈরি করা সম্ভব, যা নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তা বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব। সমুদ্র অর্থনীতিকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ  করতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। স্পিরুলিনা নামক আগাছা চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি-উইডে প্রচুর পরিমান প্রোটিন আছে-যা ফিস ফিড হিসেবে আমদানি করা ফিস অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। 

উন্নত প্রযুক্তি এবং জাহাজের অভাবে অনেক গভীর সমুদ্র এলাকা থেকে মৎস্য আহরণের পরিমাণ অনেক কম। রহস্যময় এই বিশাল জলরাশির ভেতর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শক্তির অফুরন্ত উৎস । জ্বালানি তেল, গ্যাস এসব প্রাকৃতিক সম্পদ পৃথিবীর স্থলভাগের চেয়েও বিপুল পরিমাণে সঞ্চিত রয়েছে সমুদ্রগর্ভে । সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন, জাহাজ শিল্প সম্প্রসারণ, গভীর সাগরে মাছ ধরার উপযোগী জাহাজ নির্মাণ, কনটেইনার, ওষুধ, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প বিকশিত হতে পারে। 

মৎস্য সম্পদ ছাড়াও আমাদের উপকূলে রয়েছে ৩০০ লবণ শোধনাগার, যেগুলো বিগত সাত  বছরে ৩.৫ লাখ টন করে লবণ উৎপাদন করছে। যা বাজারের চাহিদার তুলনায় খুব একটা যথেষ্ট নয়। লবণ শিল্পের দিকে একটু মনোযোগ দিলেই লবণ শিল্পকে একটি রপ্তানিমুখী লাভজনক শিল্পে পরিণত করা সম্ভব। বাংলাদেশের সীমায় সমুদ্র থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ করা হয়। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৮ লাখের বেশি মানুষ। পরিকল্পিতভাবে সুনীল অর্থনীতিকেন্দ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির যথাযথ অগ্রগতি লাভ করা সম্ভব। 

মহাসমুদ্রের সুনীল জলরাশির অন্তরালে নিহিত বিপুল অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনাই ব্লু-ইকোনমি। তার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে বৃহত্তর সমাজের। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের রিও ডি জেনিরোতে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রথম উত্থাপিত 'ব্লু-ইকোনমি' শীর্ষক ধারণা দিয়ে বোঝানো হয়, আগামীদিনের জন্য একটি মহাসমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা, যার উদ্দেশ্য হবে 'মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনা। 

সমুদ্রভিত্তিক এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনৈতিক চিত্রপট। হতে পারে সমুদ্র উপকূলরেখায় বসবাসরত লাখ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান। ব্লু-ইকোনমিতে হাত দেওয়ার আগে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ মনে রাখতে হবে- সঠিক ডাটাবেজ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সমুদ্রসম্পদের পরিমান ও মূল্যমান, সম্পদের প্রকৃত বাজার যাচাই, প্রয়োজনীয় আধুনিক অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, সঠিক কর্মপরিকল্পনা, সম্পদ অনুসন্ধান টিম গঠন, সম্পদের সংরক্ষণ, পরিবেশের নিরাপত্তা, সচল ইকোসিস্টেম মিথষ্ক্রিয়ার নিশ্চয়তা, মেরিন রিসোর্সভিত্তিক গবেষণা, পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই সম্পদ ব্যবহার নীতিমালা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১২০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের অবিচ্ছিন্ন বালুময় সমুদ্র সৈকত রয়েছে বাংলাদেশে । এক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যাপ্ত বিনোদন ও মনোরম পরিবেশের ব্যবস্থা করতে পারলে-এই খাত থেকে আয়ের পরিধি আরো বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে।

লেখক : অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026791095733643