বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দেশ । এ দেশে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ । তবুও আমরা বার বার পিছিয়ে পড়ছি । কিন্তু কেনো? সন্ত্রাস,দুর্নীতি ও অপসংষ্কৃতি আমাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিনিয়ত ব্যাহত করছে । স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সরকারের পরিবর্তন হলেও সন্ত্রাস কমেনি বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে । এদিকে দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, যদি আমরা দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকা করতে চাই..তবে ‘ঠক বাছতে গাঁ উজাড়’ হওয়ার উপক্রম হবে ! ছোট ছোট অফিস থেকে সচিবালয় পর্যন্ত সব যায়গায় দুর্নীতি । এই দুর্নীতি কী কোনো অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ করছে ? উত্তরে নিশ্চয়ই ‘না’ বলবেন । ছাত্রজীবনে যারা মেধাবী ছিলেন, দেশ-বিদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যারা দেশের নিয়ন্ত্রকের যায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তারাই একেকজন দুর্নীতিবাজ বনে গেছেন..যা সর্বজনবিদিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য ।
আমাদের আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে, অপসংষ্কৃতি । নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি । আমরা বাঙালি মুসলিম । কিন্তু আমাদের নিজেদের সংষ্কৃতি ও আত্মমর্যাদা ভুলে পশ্চিমা অপসংষ্কৃতির অনুসরণ-অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের অবস্থা আরও করুণ । অতি আধুনিকতার নামে ‘অশ্লীলতা’য় ছেয়ে গেছে চলচিত্র জগৎ ।
এই অশ্লীলতা থেকে বের হতে পারছি না আমরা । আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সিনেমা ও নাটক দেখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবৈধ প্রেম-ভালোবাসায় উৎসাহিত হচ্ছে । ফলে বাড়ছে পরকীয়া । নৈতিকতার ন্যূনতম স্থানটুকু আজ আমরা হারাতে বসেছি । এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশ এক গভীর সংকটে পড়বে-এতে কোনো সন্দেহ নেই ।
তবে আমরা হতাশ নই । সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ভাবনারও দিন দিন ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে । তথ্য-প্রযুক্তির ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে । এখনই সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও অপসংষ্কৃতিকে রুখতে হবে । এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা । আজকের শিশুরাই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার । তাই আমরা যদি বর্তমান প্রজন্মকে সঠিক ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারাই পারবে সন্ত্রাস ও অপসংষ্কৃতি মুক্ত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়তে । আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে-তা মূলত দু’টি ধারায় বিভক্ত । একটি সাধারণ ও অন্যটি মাদরাসা শিক্ষা । ইংরেজ প্রবর্তিত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে.. যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতা শেখার কোনো সুযোগ পায় না ।
অন্যদিকে, মাদরাসা শিক্ষার সিলেবাসেও ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা রূপে শিক্ষা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই । নেই বাস্তবভিত্তিক, কর্মমুখী ও কারিগরী শিখন-শিক্ষণ। ফলে তাদের জন্য নেই সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র । এ দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা কিছু লোককে ধর্মীয় শিক্ষার নামে সমাজ ও জাতি পরিচালনা এবং নেতৃত্বের আসন থেকে নামিয়ে মানবব্জীবনের এক সীমিত প্রাঙ্গণে এনে দাঁড় করাচ্ছে । আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখেছে । ইসলামের বিশ্বজনীন রূপকে তাদের কাছে উপস্থাপনের কোনো চেষ্টাই এ ক্ষেত্রে করা হয়নি । মোদ্দা কথা, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা না পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে মানুষের মাঝে তুলে ধরতে পেরেছে, না আদর্শ ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে । প্রচলিত এই ধার করা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এবং আমাদের সভ্যতার প্রতি ঘৃণাভাব পোষণকারী প্রজন্ম সম্পর্কে মহাকবি ইকবাল সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন-
‘তুমি অন্যের জ্ঞান অর্জন করছো
অন্যের কাছ থেকে ধার করা..রুজ দিয়ে নিজের চেহারা রঙিন করছো ।
আমি জানিনা, তুমি কী তুমি? না অন্য কেউ ?
তোমার বুদ্ধিমত্তা তোমার শিকলে বন্দি । তোমার কন্ঠের নিঃশ্বাসটুকু আসছে অন্যের তন্ত্র থেকে !
ধার করা ভাষা তোমার কন্ঠে; ধার করা আকাঙ্ক্ষা তোমার হৃদয়ে ।
তুমি একটি সূর্য..একবার আপন সত্তার দিকে তাকাও ।
অপরের তারকার আলো তুমি চেনো না ?
সবার মোমবাতির চারিদিকে তুমি আর কতকাল নাচবে ?
তোমার হৃদয়ে অনুভূতি যদি থাকে, তাহলে অবিলম্বে আপন আলো জ্বালো।’
আমাদের দেশে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন যে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার নিজ সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যেমন জানতে পারবে-তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হবে, তৈরি হবে নৈতিকতাসম্পন্ন একজন সত্যিকারের মানুষ । পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন ‘আমি রাসূলকে (সঃ) প্রেরণ করেছি, তিনি মানুষদের (আল্লাহর বাণী) তেলাওয়াত করে শোনাবেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন, তাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দেবেন।’ অর্থাৎ মানুষের সামগ্রিক পরিশুদ্ধির জন্য কিতাব থেকে তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই । কেননা, আল্লাহর রাসূল (সঃ) বর্বর জাতিকে (যারা তাদের শিশুকন্যাকে জীবিত অবস্থায় কবর দিতো!) সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন, ওহি তথা প্রত্যাদেশের শিক্ষা দিয়ে । প্রখ্যাত কবি জন মিলটন বলেছেন, Education is the harmonious development of body mind and soul. অর্থাৎ শরীর, মন ও আত্মার সুসমন্বিত উন্নয়নই শিক্ষা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা’। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই নীতিগুলো চালু করতে পারলে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতিমুক্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে । তখন ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে স্ব-স্ব সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করতে শিখবে । কেননা, স্রষ্টা ও পরকালের ভয় ছাড়া সঠিকভাবে নৈতিকতার সঙ্গে সৃষ্টির সেবা করা অনেকাংশে অসম্ভব । ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রভাবে তারা নিজের বিবেক এবং জাতির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে । এভাবেই ভবিষ্যতে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অপসংষ্কৃতি মুক্ত একটি সুশীল, সুষম বাংলাদেশ গড়ে উঠবে । আর, এটাই হবে আমাদের প্রত্যাশিত ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ ।
লেখক : মোঃ ওমর ফারুক, সহকারী শিক্ষক (বাংলা), সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা