ভর্তি পরীক্ষার দুর্ভোগ কমানো হোক

গোলাম কবির |

স্বার্থপরতা অন্ধ। স্বার্থপরদের চেতনায় অন্যের দুঃখ-যন্ত্রণা, অভাব-অভিযোগ কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না।

তারা পাষাণের চেয়েও কঠিন। বলা হয়ে থাকে, দুঃখে নাকি পাষাণও গলে যায়। তারা গলে না, তারা অনড়। এত সব ভাবনা আমাদের দেশের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। তারা কোথায় ফরিয়াদ করবে? কে শুনবে তাদের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা।
এবার (২০১৭) উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ শুরু করেছে অক্টোবরের প্রথম দিক থেকে। মেডিক্যালে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা শুরু করে ফলও প্রকাশ হয়েছে যথাসময়ে। শুরু হয়েছে প্রকৌশল আর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের পালা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন ভিন্ন দিনে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই দিনে বা মাত্র দু-এক দিন সময় ফাঁকা রেখে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

এতে কী পরিমাণ দুর্গতির সৃষ্টি হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বোঝে না। এ ব্যাপারে বোধোদয়ের জন্য কিছু দিন ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। যত দূর মনে পড়ে, শিক্ষাবিদ ও সুলেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সংশ্লিষ্ট সবার দুর্গতি লাঘবের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানবানদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবুও সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণের আবেদন-নিবেদনমূলক লেখালেখির বিরাম নেই। কে শোনে কার কথা! এ যেন কবি জসীমউদ্দীনের ‘মুসাফির’ কবিতার মুসাফিরের আকুতির মতো :
‘হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি কেহ নাই শুনিবার,

নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল কেহ নাই মুছাবার। ’

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা প্রায় সমাপ্তির পথে। চলছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পালাক্রমে ভর্তিযুদ্ধ। ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটছেন ঊর্ধ্বশ্বাসে। পুরুষ সদস্যহীন মহিলা অভিভাবকদের হেনস্তা অন্তহীন। ভর্তীচ্ছু ছাত্রী হলে তো কথাই নেই। তাঁরা কন্যাদের নিয়ে অচেনা অজানা স্থানে আশ্রয়ের জন্য হন্যমান। এ অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অক্টোবরের ১৯, ২০ ও ২১ তারিখের বিরতিহীন বৃষ্টি। দুর্যোগে ফেরি পারাপার বিলম্বিত হওয়ায় কুয়েটে অনেক ভর্তীচ্ছুর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

বেশি দূর যাব না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ২০ অক্টোবর থেকে রাজশাহীর স্থায়ী আবাসিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েক লাখ ভর্তীচ্ছু ও তাদের অভিভাবক। জনতার ভারে রাজশাহীতে বলতে গেলে ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’। একই অবস্থা শুরু হবে চট্টগ্রাম-খুলনা-সিলেট ও আরো দু-একটি শহরে। ভর্তি হতে চাওয়ার দুর্ভোগ শুধু ভর্তীচ্ছু ও সংশ্লিষ্টরাই নয়, এসব স্থানের মানুষও যুক্ত বিব্রতকর অবস্থায়। ভর্তি করার নিয়মের যাঁরা প্রবর্তক, তাঁরা যে বিষয়টি অনুমানে অক্ষম। তা নয় অবশ্যই। তবে ওই যে স্বার্থপরতা, সেই বিষম শক্তি, সব কোমল অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে আংশিক মুক্তির জন্য পূর্ববর্তী পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এতে দুর্ভোগ কমেছে, কিন্তু মেধা যাচাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে শিক্ষক নামের কিছু অসাধু ব্যক্তি। তাঁরা পরীক্ষার কক্ষে অবৈধ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় শতভাগ নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন।

সরষের এই ভূত তাড়ানোর জন্য অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষা প্রয়োজন এবং তা হতে হবে বিষয়ভেদে সমন্বিতভাবে। মেডিক্যালে ভর্তিপ্রক্রিয়া যেমন সমন্বিতভাবে চলছে, তেমনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কেন পারছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে সাধারণ্যের ধারণা, তাঁরা দেশের সেরা মেধাবী। সুতরাং বিষয়টি তাঁদেরই উদ্ভাবন করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে যুক্ত সবার মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ লক্ষ করা যায়। কারণ হলো, বাড়তি টাকা পাওয়া। সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণ করলে বাড়তি টাকার অঙ্ক কমে যাবে। তাই জনগণের দুর্ভোগের কথা তাঁদের ভাবনায় আসে না। এ সত্য উপলব্ধি করা দরকার, জনগণ আছে বলেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকে আছে। তাদের বলেই দেশের বল। এসব কঠিন ও তিক্ত কথা বলতে হলো দুঃখে এবং ক্ষোভে। নিজের চোখে মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে মানুষ হয়ে তো চুপ থাকা যায় না।

আমরা আবারও বলি, যা হওয়ার তা হয়ে গেল। সামনের দিনে পড়তে এবং পড়াতে চাওয়া করুণ মুখের মানুষগুলো যেন এমন দুর্ভোগের শিকার না হয়। যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে জনগণের কষ্ট লাঘব করা না যায়, তবে নীতিনির্ধারকদের উচ্চশিক্ষার লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কারণ কষ্টার্জিত যে শিক্ষা কর্মজীবনে প্রয়োগের সুযোগ কম, তার পেছনে এত অপব্যয়ের ভার এবং দুর্ভোগের বোঝা কমিয়ে ফেলাই সমীচীন। এতে শিক্ষা সংকোচনের চিন্তা অমূলক। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এবংবিধ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বিদ্যা গেলানোর কারখানা। আর প্রমথ চৌধুরী ভাবতেন, এগুলো ব্যাধি সংক্রমণের আস্তানা। তাই তাঁর ধারণায়, স্বশিক্ষিত লোক মাত্রই সুশিক্ষিত। সুতরাং বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা সর্বজনীন রেখে উচ্চশিক্ষা সীমিত রাখলে জ্ঞানপিপাসু স্বশিক্ষিতরাই জাতি রক্ষায় সহায়ক হবে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী কলেজ

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035982131958008