ভারতের স্কুলগুলোয় লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবিলায় ক্রিকেট

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটি প্রকল্পের আওতায় ছেলে ও মেয়েদের এমন কাজ শেখানো হচ্ছে যা অনেকে ভাবতেও পারেনি।

ভারতে ক্রিকেট নিছক কোন খেলা নয়, বরং এর সঙ্গে মিশে আছে গোটা জাতির আবেগ অনুভূতি। ভারতজুড়ে প্রায় প্রতিটি স্কুলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্রিকেট খেলার নানা কৌশল অনুশীলন করে থাকে।

তবে এখানে যে স্কুলটির কথা বলা হচ্ছে সেখানে ক্রিকেট অনুশীলনের উদ্দেশ্য আরেকজন ভিরাট কোহলির মতো সুপারস্টার তৈরি করা নয়।

তাদের লক্ষ্য ক্রিকেট চর্চার মাধ্যমে প্রথাগত লৈঙ্গ বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে সমতা প্রতিষ্ঠা করা।

সুমিত্রা কুমারী পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

তিনি বলেন, "ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষ গ্রামে বসবাস করে। যেখানে অনেক শিশুকে নারী পুরুষের আলাদা ভূমিকার গৎবাঁধা ধারণার মুখোমুখি হতে হয়।

একজনের কাজ, আরেকজনের উপহাস
গ্রামীণ পরিবেশে নারী পুরুষের মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য দেখা যায়।

প্রথমত, সেখানে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বড় ধরণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কাজের ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে।

ছেলেদের ক্ষেত্রে আশা করা হয় যে তারা বাড়ির বাইরের সব কাজ করবে যেখানে মেয়েরা ব্যস্ত থাকবে ঘরের ভেতরের কাজকর্ম নিয়ে।

যদি একটি মেয়ে বিভিন্ন ধরণের খেলা যেমন, সাঁতার, ক্রিকেট বা ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে চায়, তখনই তাদের লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

একইভাবে, যদি কোন ছেলে রান্নাবান্না করতে বা নাচতে আগ্রহী হয় তবে তাকেও সমাজের ভ্রূকুটি সহ্য করতে হয়।

কেউ সহযোগিতা দূরে থাক উল্টো তাদের উপহাস করতে থাকে।

গৎবাঁধা মানসিকতা

এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ব্রিটিশ কাউন্সিল একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে। যার নাম রাখা হয় দ্য চেইঞ্জিং মুভস, চেইঞ্জিং মাইন্ড। অর্থাৎ কাজের পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিকতার পরিবর্তনের চেষ্টা।

এই প্রকল্পের আওতায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট ও নাচ শেখানো হয়।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের আশা এর মাধ্যমে তারা ভারতীয় সমাজের গৎবাঁধা মনোভাবে পরিবর্তন আনতে পারবে।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক অ্যালান গেমেল মনে করেন, খেলার একটি সার্বজনীন ভাষা রয়েছে।

তিনি বলেন, "খেলা একটি দলগত কাজ। যেখানে সবাইকে একীভূত করা যায়। এক্ষেত্রে সারা ভারতজুড়ে ক্রিকেট এমনই একটি শক্তিশালী সংযোগ স্থাপনকারী খেলা।"

এই স্কিমে অংশগ্রহণকারী শিশুদের নৃত্য এবং ক্রিকেটের দক্ষতার ওপর ধারাবাহিক অনুশীলন করানো হয়।

যেমন নাচের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুদ্রা ও কোরিওগ্রাফি এবং ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের কৌশল শেখানো হয়।

"এসব বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে গৎবাঁধা ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। যেখানে এটা বোঝানো হয় যে ছেলেদের কাজ বা মেয়েদের কাজ বলে কোন কথা নেই। কাজ সবার ক্ষেত্রে সমান।" বলেন মিস্টার গেমেল।

ক্রিকেটের তালে নাচ নাকি নাচের তালে ক্রিকেট

প্রকল্পটির আওতায় শিক্ষকদের এমন কিছু বিষয়ে অনুশীলন করানো হয় যেন তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যেন তারা নারী পুরুষের ইতিবাচক ভূমিকার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিতে পারেন।

অ্যালেন গেমেল বলেন, "আমরা আশা করি যে আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস মানুষের আচরণ বদলে দিতে পারে বা মানুষকে তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা জীবনে কিছু বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে"।

মিজ কুমারী সেই শিক্ষকদের দলের মধ্যে একজন যিনি এই পাইলট স্কিমে অংশ নিয়েছেন।

ব্রিটিশ কাউন্সিল, এই স্কিমটি ম্যারিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব এবং রয়্যাল একাডেমী অব ড্যান্সের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালনা করছে।

প্রকল্পটির আওতায় মিজ কুমারী, শিশুদের একটি নতুন ধরণের নাচ শিখিয়েছেন যেখানে ভারতীয় নাচের পদক্ষেপের সাথে ক্রিকেটের নানা কৌশলের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে।

"আমরা জানিনা কিভাবে ব্যাট ধরতে হয়"

মিজ কুমারী বলেন, "প্রথম দিকে শিশুরা অনুশীলনগুলো করতে চাইতো না। তারা বেশ অস্বস্তি বোধ করতো।

একদিন একটা ছেলে বলেই বসে, "আমরা কিভাবে মেয়েদের সাথে নাচবো? আরেকজন যুক্তি দেখায় যে "মেয়েদের সাথে ক্রিকেট খেলা অসম্ভব"।

অন্যদিকে, মেয়েরা তাকে জানায় যে, "আমরা জানিনা যে কিভাবে ব্যাট ধরতে হয় এবং আমরা ক্রিকেট খেলতে পারব না।"

তবে তাদের এই মনোভাব পরিবর্তন হতে শুরু করে।

মিজ কুমারী বলেন, "আমরা এ নিয়ে শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারপর তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী ও অনুপ্রাণিত করে তুলতে নিয়মিত কাউন্সেলিং করেছি"

এরপর, মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে এবং ছেলেরা নাচতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।

শিশুরা আমার কাছে খোলামেলা কথাবার্তা বলতে শুরু করে এবং তাদের সমস্যা আমাকে জানায়।

ভাল ইনিংস
এই প্রকল্পটি এখন সারা ভারতের স্কুলগুলোতে চালু করা হচ্ছে যার আওতায় তিন লাখ ক্ষুদে ছেলেমেয়ের আনা যাবে।

গত তিন বছর ধরে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে যেসব শিক্ষকের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, তাদের মাধ্যমে ওই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অনুশীলন দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মিস্টার গেমেল বলেছেন, "খেলার একটি অবিশ্বাস্য ক্ষমতা আছে। আমাদের প্রকল্পটির লক্ষ্য সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রোল মডেল তৈরি করা। সেইসঙ্গে আমারা চাই ভারতের স্কুলগুলোতে ছেলে মেয়েরা যেন সব কার্যক্রমে একসঙ্গে অংশ নেয়। "

এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করছেন ক্রিকেটের মতো একটি জনপ্রিয় খেলা ও নাচের মতো শিল্পকে। যার ফলে শিক্ষকরাও শিশুদের সঙ্গে নারী পুরুষের ভূমিকার বিষয়ে খোলামেলা কথা বলার একটা সুযোগ পান।

মিজ কুমারীর স্কুলে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা হয়। যেখানে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা শিশুদের অগ্রাধিকার থাকে।

তিনি বিশ্বাস করেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের এই স্কিম সমতার প্রচারে সাহায্য করেছে।

"আমাদের স্কুলে দরিদ্র গ্রামীণ পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা বংশের মধ্যে প্রথম স্কুলে পা দিয়েছে। এই প্রকল্প লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়ে তাদের মনোভাব পরিবর্তনে সাহায্য করছে। তারা নতুন ধরণের নৃত্য শৈলী শিখছে এবং কোন সংকোচ ছাড়াই সেটা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করছে।" বলেন মিজ কুমারী।

সূত্র: বিবিসি 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029480457305908