শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ ও ডিগ্রি কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগ স্থগিত করায় সারাদেশের প্রায় ১১শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। স্থায়ী অধ্যক্ষ না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চলছে নানা রকম দ্বন্দ্ব। প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। কেবল ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেরই ২০০টি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। এরমধ্যে ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী অধ্যক্ষ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর ৬২টি প্রতিষ্ঠান, যার বেশ কয়েকটিই রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী।
গত ২৮ আগস্ট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ পদে এবং ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের সব কার্যক্রম স্থগিত করে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই আদেশের পর গত চারমাসে কোন প্রতিষ্ঠানেই স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ হয়নি।
জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠানেই একাডেমিক ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে সংকটের বিষয়ে ইতোমধ্যেই নতুন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সহায়তা চেয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। গতকাল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নিরসনের জন্য শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার ও সদস্যরা।
তারা শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক স্থগিতাদেশের কারণে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারছেন না তারা। দীর্ঘদিন ধরে অধ্যক্ষ নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, একাডেমিক কার্যক্রমও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে; অনেক ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নির্দেশনা প্রতিপালন করছেন না শিক্ষকরা। এজন্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাতিল করে দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন গভর্নিং বডির সভাপতি ও শিক্ষকরা।
অধ্যক্ষ নিয়োগের স্থগিতাদেশ বাতিল হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেছেন, ‘এখন অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই কোন প্রতিষ্ঠানেই। তবে আমরা বিষয়টি ভেবে দেখছি।’
এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার সংবাদকে বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয়ের স্থগিতাদেশের কারণে উদ্যোগ নিয়েও আমরা অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারছি না। দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্তদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। এজন্য আমরা মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাতিল করে দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগের পথ উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যক্ষ নিয়োগে স্থগিতাদেশ বাতিলের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার আশ্বাস দিলেও কার্যত কোন অগ্রগতি নেই। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এমনকি প্রার্থীদের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থগিত করতে বাধ্য হয় পুরো প্রক্রিয়া। অথচ প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১০ বছর ধরে পরিচালিত হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। ভিকারুননিসার মতো অন্য প্রতিষ্ঠানও এবার নতুন মন্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে সংকটের সুরাহা চান।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর ৬২টি কলেজ চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক দিয়ে, যার মধ্যে মহানগর উত্তরের ৩৫টি ও দক্ষিণের ২৭টি। এছাড়া ঢাকা জেলায় ৮টি, নারায়ণগঞ্জে ১১টি, গাজীপুরে ২১টি, ফরিদপুরে ছয়টি, মুন্সিগঞ্জে তিনটি, টাঙ্গাইলে ৩২টি, কিশোরগঞ্জে ১৮টি, রাজবাড়ীতে ৯টি, নরসিংদীতে ১৭টি, মাদারীপুরে দুটি, মানিকগঞ্জে তিনটি, গোপালগঞ্জে ছয়টি, শরীয়তপুরে দুটি প্রতিষ্ঠান চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। একই সমস্যা রয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, যাশোর, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ প্রায় প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডেই। সারাদেশে প্রায় ১১শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ী অধ্যক্ষ নেই।
অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ স্থগিত থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী সংবাদিকদের বলেছেন, ‘সারাদেশেই কম বেশি এই সমস্যা রয়েছে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল; আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠিয়েছি।’
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চলা ঢাকা মহানগর উত্তরের ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো- শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজ, মিরপুর বাঙলা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, আড্ডা আলাতুন্নেচ্ছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা পাবলিক কলেজ, ঢাকা বয়েজ কলেজ, উত্তরা টাউন কলেজ, আমজাদ আইডিয়াল কলেজ, রামপুরা একরামুন্নেছা কলেজ, টাচস্টোন কলেজ, আকিজ ফাউন্ডেশন কলেজ, এমিনেন্স কলেজ, কুর্মিটোলা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট, পল্লবী কলেজ, উত্তরা আইডিয়াল কমার্স কলেজ, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা সিটি কলেজ, সাঁতারকুল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কামারপারা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুইন মেরি কলেজ, হাজী কলেজ, নওয়াব হাবীবুল্লাহ মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা মডেল কলেজ, উত্তরা গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, গ্লোরি কলেজ, কুইন্স কলেজ, আহসানিয়া মিশন কলেজ, সরোজ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, বনফুল আদিবাসী গ্রিন হার্ট কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ এবং উত্তরা কমার্স কলেজ।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২৭টি প্রতিষ্ঠান হলো- হাজী আবদুল আউয়াল কলেজ, ইস্পাহানি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিজা রহমান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা পাবলিক কলেজ, কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এইচআর মেমোরিয়াল কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও সরকারি কলোনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নবকুমার ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড ড. শহিদুল্লাহ কলেজ, ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যাত্রাবাড়ি আইডিয়াল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, মান্নান হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও আইডিয়াল কলেজ, রোকেয়া আহসান কলেজ, শ্যামপুর বহুমুখী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, রংমালা আকবর মহিলা কলেজ, এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ, ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্বেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সাফির আইডিয়াল কলেজ, হাজী সেলিম ডিগ্রি কলেজ, দনিয়া কলেজ, মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ ও মহানগর আইডিয়াল কলেজ।
সূত্র: সংবাদ