ভালোবাসা হোক বইয়ের সঙ্গে

জুরানা আজিজ |

খুব ছোটবেলায় আমি ক্লাসে খুবই অমনোযোগী ছিলাম। ক্লাসের গত্বাঁধা লেখাপড়া আমার কখনোই ভালো লাগত না। সব কিছুই দুর্বোধ্য মনে হতো। ধীরে ধীরে আমি আবিষ্কার করলাম, আসলে ক্লাসে আমার তেমন কোনো বন্ধু তৈরি হয়নি। কাউকেই চিনতে পারি না। শিক্ষকদের পড়া বুঝতে পারছি না। কারণ কোনো পাঠ্য বই-ই আমার আকর্ষণীয় লাগছে না। কী মনে করে একদিন একা একা বই খুলেছি। অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটে গেল। বইয়ের চরিত্রগুলো আমার কাছে অনেক আপন মনে হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ আমার মাথায় গেঁথে গেল। ভীষণ আনন্দ হলো। মনে হলো বীরপুরুষ আমার কত চেনা। এরপর একে একে পড়তে শুরু করলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকুমার রায়, শরত্চন্দ্র, আরো অনেককে।

প্রতিটি বই যেন আমার সঙ্গে কথা বলত। সবাইকে মনে হতো আমার খুব নিকটজন। কাবুলিওয়ালার মিনি কিংবা পোস্টমাস্টারের রতন অথবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয়কাতুরে মাহবুব। সবাই নানাভাবে আমাকে অনুপ্রেরণা দিতে লাগল। আমি সাহসী হয়ে উঠতে লাগলাম। আমার মনের ভয়, লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ কমে যেতে লাগল। সেই থেকে শুরু হলো বইয়ের সঙ্গে ভালোবাসা

বইমেলা শুরু হলেই আমার অদ্ভুত রকম ভালো লাগা শুরু হয়। আমি প্রতিবছর অপেক্ষা করি এই ফেব্রুয়ারির জন্য। আমাদের শিক্ষার্থীদের আজকাল বইয়ের সঙ্গে আদতে বন্ধুত্ব হয় কি না, জানি না। তবে তারা নিশ্চয়ই বইমেলায় যায়। এই ‘যাওয়া’ থেকেই শুরু হবে বইয়ের সঙ্গে ভালোবাসা। ভালোবাসাটা তৈরি হয়ে গেলেই বইগুলো তাদের সঙ্গ দিতে শুরু করবে। তখন তারা আমার মতোই আবিষ্কার করবে—প্রতিটি বই তাদের সঙ্গে কথা বলছে। নানা ভাষায়। বইয়ের ভাষা দুর্বোধ্য মনে হবে না। আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, বই হলো শ্রেষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু আমরা এটি আজকাল অনেকাংশেই ভুলে গিয়েছি। আমরা সান্ত্বনা খুঁজতে যাই মানুষের ভিড়ে, ফেসবুকে ও তথাকথিত জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি, মানুষ আমাদের আসলে ধারণ করতে পারে না। নিজেকেই আমাদের ধারণ করতে শিখতে হয়। সত্যি কথা কি, বই-ই পারে কাজটি করতে। একেকটি বই আমাদের নিয়ে যায় জীবনের অনেক গভীর বোধের কাছাকাছি। আমরা প্রতিনিয়ত ধাক্কা খাই। ধাক্কাগুলো খেয়ে কেউ কেউ মুখ থুবড়ে পড়ে। কেউ বা উঠে দাঁড়ায়। যারা মুখ থুবড়ে পড়ে, তাদের জন্য বলতে চাই, বই আঁকড়ে ধরে একবার দেখুন। কতটা শক্তিশালী ও সাহসী মনে হবে নিজেকে। সত্যিকার সমাধান কেউই দিতে না পারলেও বইগুলো আপনাকে মনের একটি উচ্চস্তরে নিয়ে যাবে। সেই স্তরে ভাবনাগুলো জটিল থেকে সহজতর হবে, অনুভূতিগুলো আবেগীয় থেকে বাস্তবিক হবে, অন্তর্দৃষ্টি অন্তরাল থেকে আলোতে আসতে চাইবে।

এই আলো আপনাকে বাকিটা জীবন সুন্দরের পথ দেখাবে। তখন মানুষরূপী বন্ধুদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। সত্যিকার বন্ধু হবে বইয়েরা।

আমরা মানুষ হিসেবে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করি; কিন্তু আমাদের মধ্যে কত যে পঙ্কিলতা। আমাদের এই পঙ্কিলতা সত্যিকার ‘আমি’ হয়ে উঠতে বারবার বাধা দেয়। জীবনের শেষ প্রান্তে মনে হয় ‘আমি’ আর হয়ে উঠতে পারলাম না। আমিত্বে পৌঁছতে চাইলে জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করতেই হবে। সত্যিকার জ্ঞানেই আলো। সত্যিকার জ্ঞান আমার ‘আমি’কে প্রতিনিয়ত শুদ্ধ করে। একটি ভালো বই জ্ঞান পরিবেশন করে। বইমেলায় গিয়ে একটু চমকে গেলাম। কফির একটি দোকান। অসম্ভব ভিড়। মনে হলো জীবনধারণ হয়তো জ্ঞান অর্জনের কাছে পরাজিত হয়ে গেছে। পরমুহূর্তে এক ঝাঁক তরুণকে দেখলাম, হুড়মুড় করে বইয়ের দোকানে ঢুকেছে। মনটাই ভালো হয়ে গেল। এই হুড়মুড় করে অনুপ্রবেশ আমাকে আবারও অনুপ্রাণিত করল। বুঝতে পারলাম, আদিমকাল থেকে মানবমনের ‘আমি’ হয়ে ওঠার যে আকুতি, সেটি এতকাল পরেও বিদ্যমান।

‘আমি’ হয়ে ওঠার জন্য চলুন বেশি বেশি বই পড়ি।

ভালোবাসা—সব লেখকের জন্য।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027909278869629