ভাষার বৈচিত্র্য কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি?

ড. মাহফুজ পারভেজ |
বইমেলায় দাঁড়িয়ে এন্তার প্রকাশনা, লাগাতার আলোচনা, যান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতা, পদক বিতরণ, কেনাবেচা, হট্টগোল ইত্যাদি মচ্ছবের মধ্যে চিন্তার পরিসর খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে। ভাষা বিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্র যে আরো সঙ্কুচিত, সেটা অনুভব করতে কষ্ট হয় না। একটি প্রশ্ন, রাজনৈতিক মদদে কর্তা হওয়া লোকজন এড়িয়ে যাচ্ছেন দেখে অবাক হই না এইজন্য যে, তাদের ভাষাস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ আলিঙ্গনাবদ্ধ। 
 
উপরের এই উপলব্ধি অধ্যাপক, লেখক, কবি ও কথা সাহিত্যিক ড. মাহফুজ পারভেজ এর।
 
অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে সম্প্র্রতি দৈনিক আমাদের বার্তাকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।  
 
ইতিহাস ও উপন্যাসসহ বেশ কিছু গ্রন্থের সফল রচয়িতা তিনি। চলমান বইমেলাতেও রয়েছে তার  একাধিক নতুন গ্রন্থ। কিন্তু ড. মাহফুজ পারভেজ কথা বলেন বাংলা ভাষার অর্জন, হতাশা, করণীয় ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে।  
 
ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, প্রশ্নটি জরুরি। আমাদেরকেই এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে ও উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। প্রশ্নটি হলো, আমরা বাংলা ভাষার বৈচিত্র কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি? দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ কাজ কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছে?
 
তিনি বলেন, সবার জানা যে, একই ভাষার বিবিধ বিচিত্রতা একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। ব্রিটিশ ইংরেজির সঙ্গে আমেরিকান বা অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজির সূক্ষ্ম পার্থক্য আসলে বৈচিত্র্যের পরিচায়ক। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই বিচিত্রতা সামাজিক জীবনে বরণ করে নিলে বাঙালির ভাষাগর্ব আরো সার্থক হতো।
 
দৃষ্টান্তরূপে বলা যায়, বৃহত্তর বাংলা ভাষা অঞ্চলের পশ্চিমাংশের বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাংলার পাশে এদিকের ‘নোয়াখাইল্যা’ বা ‘সিলটি’ বাংলাকে সমান উৎসাহে স্বীকার করে নিলে তো কোনো ক্ষতি নেই। এতে ভাষার বৈচিত্র, সক্ষমতা ও শক্তিই বরং বৃদ্ধি পায়। মেদিনীপুর কি গঙ্গাসাগরের বাংলার সঙ্গে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ বা রংপুরের বাংলাকে মিলিয়ে দিতে পারলে বুক চিতিয়ে বাংলা ভাষা তার শক্তি ও গভীরতা আরো ব্যাপকভাবে দেখাতে পারতো । 
 
অধ্যাপক পারভেজ বলেন, সমাজমনের উৎসাহ না পেলে, স্রেফ ভাষাতাত্ত্বিকের আগ্রহে ভাষা বাঁচে না। বহু ভাষা সমাজ-বিযুক্ত হওয়ায় অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাকে তাই রাজধানী বা মাসোয়ারা-ভোগী পণ্ডিতদের ঘেরাটোপ ছিন্ন করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভাষাভঙ্গিকে আলিঙ্গন করতে হবে। মানুষের মুখে উচ্চারিত প্রান্তিক জনপদ ও জনগোষ্ঠীর ভাষা যদি অবহেলিত হয়, তাহলে ভাষার মূলস্রোত দুর্বল হতে বাধ্য। বাংলা ভাষাকেও আমরা বিবিধ বিচিত্রতা থেকে বিমুখ রেখে এবং জনবিচ্ছিন্ন ও স্বার্থবাদী পণ্ডিতদের কব্জাবন্দি করে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ণ করছি।
 
তিনি বলেন, বইমেলায় রেকর্ড ভিড়, পদক-পুরস্কারের জোয়ার, রেকর্ড বই বিক্রির খবরে বাংলা ভাষা-সাহিত্যপ্রেম ফুটে বেরোচ্ছে বটে। দরিদ্র ও প্রান্তিকজনের ভাষার বেহাল দশা ফলে কারো চোখেই পড়ছে না। আঞ্চলিক ভাষা-প্রবাহ সমালোচকদের হিংসায় অনাদরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজির হ্যাংওভারের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিকৃতি ভাষাকে বিকৃত করছে। এসব বিপদ নিয়ে ভাবনাচিন্তার ফুসরত উদ্বাহু নৃত্যরত পণ্ডিতদের নেই। হয়তো আবার একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ জন্ম নিলে তিনি ভাষা আত্মা ও বৈচিত্র স্পর্শ করতে পারবেন!
 
ড. মাহফুজ পারভেজ আরও বলেন, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের রূপকারদের সামনে কোনও ‘লেগ্যাসি’ ছিল না, পথ করে নিতে হয়েছিল সংস্কৃত আর ইংরেজি এই দুই ভাষার প্রবল প্রতাপের মধ্য দিয়ে। বিশ্বায়নে যুগেও ভাষাকে পথ চলতে হচ্ছে নানা দুর্বিপাক পেরিয়ে। ভাষার বৈচিত্র স্বীকার করলে আমরা লড়াইয়ের শক্তি পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলা ভাষার বিবিধ বৈচিত্রকে আমরা স্বীকার  করলাম না।
 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061318874359131