ভাষার মর্যাদা, বইমেলা ও বইপড়া

সাধন সরকার |

মাত্র ক’দিন আগে পত্রিকায় একটি ঘটনা পড়লাম। শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে কথা বলতে বলে চাকরি হারিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক। মূলত ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেন না।

এ কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষা কার্যক্রমের পরিচালক ড. মেগান নিলির কানে যায়। তিনি বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে থাকাকালে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা না বলার নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই চীনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদ।

এ ঘটনার জের ধরে সংশ্লিষ্ট ঐ সহকারী অধ্যাপককে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মূলত মাতৃভাষার প্রতি গভীর টান থেকেই চীনা শিক্ষার্থীদের এ ধরনের প্রতিবাদ গড়ে ওঠেছিল। মাতৃভাষার প্রতি গভীর আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা না থাকলে সে জাতির টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সুদূরপরাহত। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা।

তবে কেন ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পরও ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে? সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার যে জাতীয় অঙ্গীকারের কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? এটা নিয়ে ভাবতে হবে যে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি কী।

কেন জানি মনে হচ্ছে মাতৃভাষার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। চারদিকে ইংরেজিতে লেখা পোস্টার-ব্যানারের জয়জয়কার। স্কুল-কলেজগুলোতে ভালো করে না শেখানো হচ্ছে বাংলা, না শেখানো হচ্ছে ইংরেজি। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এখন ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীতে মাত্র ৪০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। অথচ এ ভাষার প্রতি কতই না গুরুত্ব! ধার করা ভাষায় আর যাই হোক পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া কঠিন!

নদীর ওপারেতে বেশি সুখ খোঁজার মতো মাতৃভাষা বাংলা সঠিকভাবে আয়ত্ত না করে ইংরেজির প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ কোনো ফল বয়ে আনতে পারে না। এখন আমরা না বুঝে বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার তুলনা করছি। ছোটবেলা থেকে সন্তানকে ইংরেজি শেখানোর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি।

সর্বোপরি বাংলা ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীক, সামাজিক ও ব্যক্তিক অবহেলা বাড়ছে। ‘ভালো বাংলা বলতে পারি না’— এটা বলতে পারাটাও যেন এক ধরনের যোগ্যতা হয়ে গেছে! সর্ব্বোচ আদালতে এখনো রায় লেখা হয় ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিতে। যে ভাষার জন্য অকাতরে রক্ত বিলিয়ে দিতে হয়েছে, সেই মাতৃভাষার প্রতি কি আমাদের দায়বদ্ধতা নেই ? স্বাধীনতার পর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল, সেগুলো পরে আর এগিয়ে নেওয়া হয়নি কেন, সে ব্যাপারে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

সর্বক্ষেত্রে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শিশু বয়স থেকে শিক্ষার্থীর বাংলা ভাষার শোনা-বলা-পড়া-লেখা দক্ষতার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে বাংলা।

বাঙালির বইমেলা আজ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ হচ্ছে। মানুষের মতো মানুষ হতে চাইলে সবার আগে চাই মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ জ্ঞান। মনের বিকাশ, নৈতিক চেতনার বিকাশ একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা।

একুশের চেতনা ও মর্যাদাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য অন্য সবার সাথে লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে চলেছেন। বই দেশ গড়া ও জাতি গড়ার প্রথম ও প্রধান উপাদান। বই-ই পারে সকল সংশয় থেকে আলোর পথের সন্ধান দিতে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে পড়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর দিনের বিশাল একটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বসে থেকে কতটা সামাজিকতার বিকাশ হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে! এ ব্যাপারে পরিবারের মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে।

তরুণ শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। অবসর সময়ে বই-ই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এখন থেকেই যদি প্রত্যেক পরিবারে ঘরের কোনো একটি কোণে লাইব্রেরি গড়ে তোলা যায় তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ভাষা ও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আরও দৃঢ় হবে।

লেখক :সাবেক ছাত্র, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004439115524292