ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের আজ জন্মদিন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা-আন্দোলনের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আ.ন.ম গাজীউল হক এর আজ জন্মদিন। তার পুরো নাম আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক। তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও মাতা নূরজাহান বেগম।

গাজীউল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কাশিপুর স্কুলে। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে  বিএ অনার্স  ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন ।

গাজীউল হক স্কুলজীবন থেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলে থাকা অবস্থায় রমনার নিকটবর্তী একটি সরকারি ভবনের ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে সেখানে মুসলিম লীগের পতাকা উঠানোর জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ’ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং এ বছর কুষ্টিয়ায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হন।

গাজীউল হক ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রৃভাষা করার ঘোষণা দিলে, প্রতিবাদ মিছিলে গাজীউল হক নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আহ্বানকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ সভা থেকেই ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতা মিছিল করলে পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার ও আবদুস সালাম শহীদ হন। 

ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক গাজীউল হকের নেতৃত্বে ৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হলে, সরকারের চাপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি বাতিল করে দেয়, কিন্তু পরে তার ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের সময় তখনকার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার দরুন তিনি গ্রেফতার হন। তাছাড়াও ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি রমেশ শীল, মুনীর চৌধুরী, অজিতকুমার গুহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসেন। গাজীউল হক কেবল ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন না, ৬২-র শিক্ষাসংস্কার-আন্দোলন, ৬৪-র সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে গাজীউল হকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে তার নেতৃত্বে সাতাশজন যুবক, ঊনচল্লিশজন ইপিআর ও পুলিশসহ উত্তরবঙ্গের আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট শত্রুমুক্ত হয়। আড়িয়ার এ যুদ্ধকে মরিচের যুদ্ধও বলা হয়। এ যুদ্ধের পর তিনি পাকসেনাদের বিরুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের হিলিতে সংঘটিত একটি খন্ডযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয় বাংলা পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন। নববইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন।

গাজীউল হক আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য এবং ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাছাড়াও তিনি ‘প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ’ (পিআইবি)-এর এবং বগুড়া হামদর্দ ইউনানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন।

গাজীউল হক অল্প বয়স থেকে লেখালেখি করতেন। জেলে থাকার সময়ও তিনি কিছু সংখ্যক কবিতা ও গান লিখেছেন। তার রচিত: ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না/এই একুশে ফেব্রুয়ারি...’ -এ গানটি গেয়ে প্রভাত ফেরি করা হতো। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: জেলের কবিতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এগিয়ে চলো, বাংলাদেশ আনচেইন্ড, মিডিয়া ল’স এ্যান্ড রেগুলেশন্স ইন বাংলাদেশ, মোহাম্মদ সুলতান, বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন ও বিধিমালা, উচ্চ আদালতে বাংলা।

প্রগতিশীল আন্দোলন ও অন্যান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বেশসংখ্যাক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তার মধ্যে পাবনা থিয়েটার পুরস্কার, রাষ্ট্রভাষা পদক, ভাষা সৈনিক পদক, সিপাপ জাতীয় স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ অর্জন, বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার, একুশের পদক, জাহানারা ইমাম পদক, বঙ্গবন্ধু পদক, শেরে-বাংলা জাতীয় পুরস্কার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এসোসিয়েশন-এর ৭ম পূণর্মিলনীতে তাকে ক্রেস্ট উপহার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তন এ তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেয়া হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কলেজে সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া কোটায় ভর্তির সুযোগ - dainik shiksha কলেজে সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া কোটায় ভর্তির সুযোগ শিক্ষা সংস্কারে বাংলাদেশ-চীন কাজ করবে - dainik shiksha শিক্ষা সংস্কারে বাংলাদেশ-চীন কাজ করবে বয়স ৯ না হলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন নয় - dainik shiksha বয়স ৯ না হলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন নয় প্রাথমিকের ডিজিকে অপসারণে পঞ্চম দিনের আন্দোলন - dainik shiksha প্রাথমিকের ডিজিকে অপসারণে পঞ্চম দিনের আন্দোলন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান ‘মিনিস্ট্রি অডিটর’ হতে আগ্রহী হাজারো শিক্ষা ক্যাডার ! - dainik shiksha ‘মিনিস্ট্রি অডিটর’ হতে আগ্রহী হাজারো শিক্ষা ক্যাডার ! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া কর্মচারীদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া কর্মচারীদের তথ্য আহ্বান এমপিওবিহীন ৩য় শিক্ষকদের বাদ পড়ার কারণ জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha এমপিওবিহীন ৩য় শিক্ষকদের বাদ পড়ার কারণ জানতে চায় অধিদপ্তর সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষা ফিরছে - dainik shiksha সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষা ফিরছে অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন শুরু ১০ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন শুরু ১০ সেপ্টেম্বর দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055928230285645