শিরোনামটা আমি ধার করেছি। সদ্য নোবেল পাওয়া বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা তাঁর একটি কলাম থেকে। অমর্ত্য সেনের ছাত্র। জনকল্যাণমূলক অর্থনীতিই তাকে বিশ্বের এই সেরা পুরস্কারটি এনে দিয়েছে। এ নিয়ে বাঙালির গর্ব ও আনন্দে ভাসছে দুই বাংলার বাঙালি। কিন্তু তাঁর অর্থনীতির মূল দর্শন সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? হয়তো এরপর আমরা জানতে চেষ্টা করব। তবে যেটুকু গুগলের কল্যাণে জেনেছি, তিনি বলেছেন যে- ধনিক শ্রেণির ওপর ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে বাড়তি অর্থ গরিবদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের জন্য খরচ করতে হবে। আর শিরোনামটিই প্রমাণ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিভিন্ন মত ও পথের মিলনস্থল। সেখানে প্রত্যেকের চিন্তাভাবনাকে সম্মান জানানো বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার পরিধি বৃদ্ধি করবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। অভিজিৎ সম্পর্কে আজ আর বেশি কিছু লিখব না। মূল কথায় আসি। শনিবার (১৯ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
দুই. বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের উর্বর ক্ষেত্র। অনুশীলনের মাধ্যমে পরিশীলিত হওয়ার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে মুক্ত-স্বাধীন। সেখানে 'টর্চার সেল' গড়ে উঠতে পারে না। বিশ্বের এক হাজারটি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও নাম নেই দেখে অনেকে কষ্ট পেয়েছেন। এ নিয়ে বেশ কিছু লেখা বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছে। তা ছাড়া সম্প্রতি ১৯টি তথাকথিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা রকম দুর্নীতি ও রসালো খবর দেশবাসীর মনে হতাশার সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর 'দেশে-বিদেশে' পত্রিকার সায়েম বাবু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। অধ্যাপক জামান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে ধরনের খবর প্রকাশ পাচ্ছে তাতে চরম হতাশা প্রকাশ ছাড়া উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের বাতিঘর। এখানে সবচেয়ে মেধাবীরা আসে আলোকিত হতে। সেখানে যদি অন্ধকার নেমে আসে, তাহলে সমাজ আর আলোর পথ দেখবে না। আলোর পরিবর্তে অন্ধকার নামছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।' গত ১৫ অক্টোবর দি ডেইলি স্টারে এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, 'নির্ভেজাল স্বায়ত্তশাসনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে পারে।' ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক গুপ্ত বলেন, 'সরকারের সমালোচনা করা দেশদ্রোহ নয়।' তিনি বলেন, 'বছরের পর বছর একই ধরনের চিন্তাভাবনা আঁকড়ে চললে সেই সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। কোনো সমাজে নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা তখনই তৈরি সম্ভব, যদি সেখানে কেউ প্রতিষ্ঠিত ভাবধারার বিরোধিতা করে। সবাই যদি সেই প্রথাগত চিন্তাভাবনা বয়ে নিয়ে চলে, তাহলে ভাবনার নতুন দিগন্ত কখনই তৈরি হবে না।' 'কেন'- প্রশ্নটি করা খুব প্রয়োজনীয়। (নিউজ বাংলা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯)। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আবরারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লিখেছেন (ফেসবুক, ১০.১০.২০১৯), 'আবরারের হত্যার মধ্য দিয়ে যে ক্ষতিটা হলো তা অপূরণীয়।... আমাদের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেরা দল বেঁধে তাদেরই সহপাঠীকে পিটিয়ে পিটিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল। দোষটা কি ওদের? ছাত্র রাজনীতির যে দুষ্টচক্রের মধ্য দিয়ে এই মেধাবী ছাত্রগুলো নষ্ট হলো; হয়ে উঠল একটা দানব ও দুর্বৃত্ত, সেই দুষ্টচক্রকে হটানো না গেলে, দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া নির্মূল করা না গেলে আবরাররা বলি হতেই থাকবে। সমাজ থেকে সহিষুষ্ণতার বোধ, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা, গঠনমূলক সমালোচনা, ন্যায্যতার বোধ ও মুক্তচিন্তা হারিয়ে যাচ্ছে। সেটিও যথেষ্ট শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার বিষয়।' আবরার হত্যার নিন্দা করে জাতিসংঘ বলছে, 'বাকস্বাধীনতার জন্য কাউকে হত্যা করা উচিত নয়।' বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক ৯ অক্টোবর বলেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। এর চর্চার জন্য কাউকে হয়রানি, নির্যাতন ও হত্যা করা উচিত নয়।'
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে কিংবা ক্যাম্পাসে যখন শুনি 'টর্চার সেলের' কথা, তখন ভাবতে বিস্ময় লাগে- এই কি আমাদের শিক্ষাঙ্গন? কেন বাংলাদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও এক হাজারের তালিকায় আসতে পারল না, তার সদুত্তর পাওয়া যায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দি ইকোনমিকস টাইমসে অমর্ত্য সেনের এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, 'আমেরিকা ও ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে ওঠার পেছনে আছে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজিত স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার আবহাওয়া। সরকার সেসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আর্থিক সাহায্য করলেও কোনো সরকারই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। স্বায়ত্তশাসনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। বিশ্ববিদ্যালয় যখন মতপ্রকাশে বাধা দেয়, তখন গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫ অক্টোবর একটি পোস্টে জানা যায় যে, জার্মানিতে শিক্ষকের বেতন সবচেয়ে বেশি। তাই যখন বিচারপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা শিক্ষকদের সমান বেতন দাবি করেন, তখন প্রেসিডেন্ট মার্কেল বলেন, 'এটা কী করে সম্ভব? তোমাদের যারা পড়িয়েছেন, তাদের সঙ্গে তোমাদের সমান করব কী করে?' একই সঙ্গে শিক্ষকদের উদ্দেশেও একটি বার্তা দেন- 'সাধারণ মানুষ শিক্ষক নন। শিক্ষকরাও সাধারণ মানুষ নন। যতক্ষণ যোগ্যতা অর্জন না করো, ততক্ষণ শিক্ষক হয়ো না।'
তিন. এতক্ষণ যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলাম, তাদের প্রত্যেকের মূলকথা হলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এভারেস্ট শৃঙ্গে তুলতে পারে এবং তার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ভাগাড়ে পরিণত হতে পারে। টর্চার সেলের সৃষ্টি হয় বা হতে পারে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নানা রকম আইন তৈরি করে সবার মুখে তালা লাগিয়ে দিয়ে। অথচ যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তারা ভালোভাবেই জানেন, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস ভিন্নমত পোষণ করার অপরাধে প্রাণ দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রাণের বিনিময়ে চলতি ভাবাদর্শ গ্রহণ করেননি। আজ ভ্যাটিকান স্বীকার করছে, সক্রেটিসের ওপর অন্যায় করা হয়েছিল। অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। সদ্য নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ ১৯৮৩ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে ১০ দিন দিল্লির তিহার জেলে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কোথায় সেই উপাচার্য? আজ তিনি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। আর যিনি তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন তিনি (অভিজিৎ) বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদ হিসেবে নোবেল জয় করলেন। বুয়েটের উপাচার্য, কর্মকর্তা, শিক্ষকদের এ বার্তা কি কোনো ভালো চিন্তা পৌঁছে দেবে? পৌঁছে দেবে আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের কানে? অভিজিতের ঘটনাই প্রমাণ করে- সাধারণ ছাত্রদের আমরা যতই ছোট ও অ-জ্ঞান ভাবি, তারা তা নয়। তাদের মধ্যেও যে অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ ব্যানার্জি লুকিয়ে থাকতে পারেন, এটা সবার বোঝা উচিত। আবরারও তো বাংলাদেশের জন্য এ রকম কোনো সম্মান এনে দিতে পারত! কিন্তু দীপু মনির কথা পুনরুল্লেখ করে বলি যে, আমাদের সমাজ থেকে ক্রমে পরমতসহিষুষ্ণতা, গঠনমূলক সমালোচনা, ন্যায়-অন্যায় বোধ ও মুক্তচিন্তার পরিবেশ দ্রুত অপসৃয়মাণ। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ 'অলঙ্কৃত' করেন তারা ভুলে যান যে, কত সামান্য জ্ঞানের অধিকারী। তারা নিজেকে সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। যখন যে দল ক্ষমতার মসনদে বসে, সেই দলই তাদের ছাত্র সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁবে রাখার জন্য। উপাচার্যরাও তাদের গদি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ওপর নির্ভর করতে থাকেন। সেই কারণেই ছয় ঘণ্টা ধরে বিশজন ছাত্র তাদেরই সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করল, তার আশপাশের ছাত্ররা তদের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে নিশ্চুপ বসে রইল। কারও সাহস হয়নি আবরারকে বাঁচানোর জন্য 'এগিয়ে আসার'। এমনি আতঙ্কের মধ্যে বাস আমাদের ছেলেমেয়েদের। কেবল বুয়েট নয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন বাংলাদেশের প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি দলের কী প্রতাপ। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপরই বর্তায়। কারণ আজকের উপাচার্যদের সরকারই নিয়োগ দান করে। উপাচার্যরা ক্যাম্পাসে এসে তার নিজস্ব ছাত্র-শিক্ষক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। এভাবেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'বিশ্ববিদ্যালয়' নামের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
চার. ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না থাকলে যেমন গণতন্ত্র পোক্ত হয় না, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। হয় টর্চার সেল- কারাগার। ১৫ অক্টোবর রাতে লেখাটি শেষ করেছি। ১৬ অক্টোবর সকালে 'সমকালে'র প্রধান খবরটি পড়ে ওপরের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হলো এবং রিপোর্ট পড়ে আমার গা-হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে এলো। একি? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ- ভাবতেই পারি না। এখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে পড়াশোনা করে- ভাবতেই পারি না! মনে হয় চুপচাপ ৫টি বছর কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলেই তারা বাঁচে। সমকালের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টর্চার সেলের যে তথ্যচিত্র ফুটে উঠেছে, তা ভয়ংকর। সরকার কি এই তথ্য আমলে নিয়ে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? নির্মোহ অবস্থান নিয়ে এসব ব্যাপারে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং এখনই।
লেখক: শহিদুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়