ইসলামিক ফাউন্ডেশনভৌতিক মাদরাসার নামে সরকারি টাকা লুটপাট

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) শীর্ষ কর্মকর্তার বাড়িকে মাদরাসা দেখিয়ে দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর কাগুজে নাম দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা। শিক্ষক হিসেবে মো. শাহাদাত ও মো. আলীর নামে প্রতি মাসে ১১ হাজার ৩০০ টাকা হারে ১৬ মাসের (২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের জুলাই) বেতন-ভাতা বাবদ মোট ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা তোলা হয়েছে সরকারি কোষাগার থেকে। ওই সময় ইফার মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এভাবে সারা দেশে ভৌতিক মাদরাসা নামে সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এমনকি সারা দেশে দারুল আরকাম মাদরাসায় ১ হাজার ১০ জন শিক্ষক নিয়োগ না দিয়েই বেতন-ভাতা বাবদ ১৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা তছরুপ করা হয়েছে। সরকারি নিরীক্ষায়ই এই অনিয়ম ধরা পড়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনমতে, ‘জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ শীর্ষক কর্মসূচির পুস্তক ছাপানো ও বাঁধানোর নামে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো বই প্রকাশ করা হয়নি। এ ছাড়া দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত ১৩৫ জন কর্মচারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দিয়ে তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ ১৪ কোটি ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।

এভাবেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ৯ অর্থবছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮) ২৯টি খাতে মোট ৩৬৪ কোটি ২১ লাখ ১৯ হাজার টাকার অনিয়ম করা হয়েছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব অনিয়মের তথ্য। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪০ কোটি ৩৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। আর বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ হয়েছে ২২৩ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অনিয়মের মাধ্যমে ব্যয় দেখানো অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ধর্মসচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার নিজ দপ্তরে বলেন, ‘এটি বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমি দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র দুই মাস হয়েছে। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বলতে পারব।’

জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইফার ডিজি ছিলেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল। ২০২০ সালের ২৬ জুন তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) চেয়ে কম দামে পাঠ্যপুস্তক ও কুরআনুল কারীম ছাপার অব্যয়িত ৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। ডিপিপির নির্দেশনাবহির্ভূতভাবে এবং অনুমোদিত পদের বাইরে বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৩১ লাখ ৬ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে উচ্চ দরদাতার কাছ থেকে মেশিন কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭২ লাখ ৪ হাজার টাকা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে দোকানের ইজারা মূল্যের ওপর ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করায় ৯ কোটি ৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা এবং ইজারার অর্থ জমা না করায় ৭৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। জনবল কাঠামোতে পদ না থাকলেও আইন উপদেষ্টা ও মহিলা কো-অর্ডিনেটর পদে জনবল নিয়োগ দিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় ক্ষতি হয়েছে ৬২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অর্থবছর শেষে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে না দেওয়ায় ক্ষতি ২২ কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ছাপাখানার অপ্রয়োজনীয় মেশিন ক্রয়ে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৮৮ হাজার এবং কার্যাদেশের পরিমাণের চেয়ে কম সরবরাহ নেওয়ায় ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে সরকারের।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২২৩ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা তছরুপ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পের অব্যয়িত ৯৯ কোটি ১ লাখ ৬ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ কোষাগারে জমা না দিয়ে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে দেওয়ায় ২ কোটি ২৬ লাখ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্রেসের কাঁচামাল কিনতে বিধিবহির্ভূত ৪৫ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মসূচির টাকা প্রেসের কাজে খরচ করায় ক্ষতি হয়েছে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। সরবরাহ সেবা কোডের বরাদ্দের টাকায় মূলধন জাতীয় ব্যয় নির্বাহ করায় ১ কোটি ৮ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ক্রয় বিধিমালা লঙ্ঘন করে ২ কোটি ৩১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বোর্ড অব গভর্নরের নির্দেশনা অমান্য করে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে ২৯ কোটি ৮২ লাখ ৬২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ায় ১ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে। কোটা অনুসরণ না করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়ায় বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ৭৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মহা. বশিরুল আলম বলেন, ‘অডিট আপত্তি চলমান প্রক্রিয়া। সব আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে কি না, তা এ মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে প্রতি মাসেই অডিটের জবাব দেওয়া হয়। কিছু নিষ্পত্তি হয়, আবার কোনো কোনোটির আরও ব্যাখ্যা চায়। সব নিষ্পত্তি হয়নি, সেটা ঠিক। পর্যায়ক্রমে সবই হয়তো সমাধান হবে।’

এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যেকোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম কাম্য নয়; বিশেষ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠানে তো নয়ই। অডিট রিপোর্টে যেসব বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে, তা সঠিক হলে নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানটি এর জবাব দেবে। তারা যদি আপত্তির বিষয়ে যৌক্তিক জবাব দিতে না পারে, তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অনুদান পেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনের সময় বাড়লো - dainik shiksha অনুদান পেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনের সময় বাড়লো চার হাজার আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha চার হাজার আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ - dainik shiksha সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ সব দাবি-দাওয়া একমাস বন্ধ রাখার আহ্বান নুরের - dainik shiksha সব দাবি-দাওয়া একমাস বন্ধ রাখার আহ্বান নুরের মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের - dainik shiksha গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস - dainik shiksha শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002655029296875