পহেলা বৈশাখের মুঘল চরিত্র খোলনলচে বদলে গিয়েছিল অনেক আগেই। মুঘল দরবারে খাজনার টাকা পৌঁছানো তো দিল্লি রেখে কোলকাতায় থিতু হয়েছিল কোম্পানির শাসনকালেই। তার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছিল। যেটুকু বেঁচেছিল পয়লা বৈশাখের আমেজ তা সীমিত হয়ে যায় দোকানির হালখাতায় মিষ্টিমুখ আর দেনা-পাওনা শোধের আনুষ্ঠানিকতায়।
কিন্তু কে জানত, পয়লা বৈশাখ এমন প্রবল প্রতাপে ফিরে আসবে বাংলার বুকে? মুঘল দরবারে খাজনা পরিশোধ নয়, নয় জমিদার কাচারিতে রায়তের কান্নাকাটির মর্মন্তুদ দৃশ্যও। আইয়ুবি মিলিটারি শাসন আর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতের বিরুদ্ধে শাসক শ্রেণীর বৈষম্য, বাঙালি জাতিসত্বার অনুসন্ধানে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে। পথ চিনিয়ে দিয়েছিল ছায়ানট, ঊনিশ শ’ বাষট্টিতে। পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা যেন পয়লা বৈশাখে জেগে উঠত রমনা অশ্বত্থতলে। তার এক যুগ পর উদীচী তাকে ভিন্নরূপে আবাহন করল যশোরে, সেও আরেক মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার করে। সেটি সীমিত ছিল যশোর পৌর পার্কের চার দেয়ালের মধ্যে।
শহুরে মধ্যবিত্ত ছিল তার প্রধান ধারক বাহক। কিন্তু বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচার এরশাদের দু:শাসনে বিরুদ্ধে নবীন-প্রবীণের যুগলনেতৃত্বে জন্তু জানোয়ারের মুখোশ পরে, ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে নেচেগেয়ে, লাঠিখেলে প্রতিবাদের যে নতুন রীতি যশোরে চালু হয় বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। এ দেশে এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বাংলার মাটি ও মানুষের চরিত্রের সঠিক রূপকার সুলতানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত চারুপীঠ অতীতের সব রীতি ভেঙে বের করে নিয়ে এলেন বর্ষবরণের এক নতুন দ্যোতনা। চারুপীঠ পয়লা বৈশাখকে যে নতুন অর্থ ও সামর্থ্য দান করল তা মাত্র দু’ বছরে অভাবিত জনপ্রিয়তায় সিক্ত হয়ে সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মদ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে উঠল। মনে হলো, হিমালয় থেকে বুঝি নেমে এলো হিমবাহ গলে জলের এক সমুদ্র; আর তাতে প্লাবিত হলো গোটা বাংলা। এখন পয়লা বৈশাখের তুলনা শুধুই পয়েলা বৈশাখ। মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্ব ঐতিহ্য।
মুঘল স¤্রাট আকবর পয়লা বৈশাখকে রাজস্ব সংগ্রহের যে রীতি চালু করেছিলেন, বাঙালি তাকে গ্রহণ করেছিল জমিজিরেত, জমিদারি রক্ষার প্রশাসনিক তরিকা হিসেবে। কিন্তু চারুপীঠ যে পয়লা বৈশাখ সৃষ্টি করল তা ছাপিয়ে গেল অতীতের সকল সাংস্কৃতিক উচ্ছ্বাস, আয়োজন। শুধু সেখানেই থেমে থাকল না। পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করেছে। সমাজ ্আবিষ্কার করেছে নবতর শক্তি ও সামর্থ্য। ভেঙে গেছে ধর্মের আঁধারঘেরা প্রাচীর। নতুন রাখি বন্ধনে বাঁধা পড়েছে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্বা।
উৎসবে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে সেটা স্বতঃসিদ্ধ হয়ত বা। ঈদ পূজায় আমাদের অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে তার সঠিক পরিমাপ করবেন অর্থশাস্ত্রীগণ। কিন্তু আমাদের নজরে পড়ে সে অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা বাঁধা পড়ে থাকে কর্পোরেট পুঁজি আর বিদেশী পণ্যের অবাধ বেচাবিক্রিতে। তাই ঈদ পূজায় অর্থনীতিতে যতই বান ডাকুক, তা ষোলআনা বাংলার সম্পদে মোড়া থাকে না। কিন্তু পয়লা বৈশাখ একেবারের বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ। তাই এর পুরো ফসল ওঠে বাঙালি গোলায়। এদেশের তাঁত শিল্প নতুন করে জেগে ওঠে। ফ্যাসান হাউসগুলো বাংলার পোশাকে নতুন মাত্রা যোগ করে। আর বাঙালির নানার চারুকারু শিল্প নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মাতে, নতুন নতুন আঙ্গিকে ধরা দেয়। মিষ্টান্নের প্রতি বাঙালির চিরকালীন যে অনুরাগ তাও ষোলআনা স্ফূর্তি পায় এই দিনে। এদেশের প্রিয় খাবারগুলো আবার বাঙালির রসনাতৃপ্তির সেরা উপকরণ হয়। সজ্জায় এবং রসনায় পয়লা বৈশাখের কোন তুলনাই হয় না।
ষোলআনা বাঙালিআনা বলতে যা বোঝায়, পয়লা বৈশাখ ঠিক তাই। মাঝে কিছুকাল কিছু কর্পোরেট হাউস ভিনদেশী সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাঙালি তা ঠিকই রুখে দিয়েছে। পয়লা বৈশাখই হয়ে উঠেছে এদেশের সর্বজনীন উৎসবের দিন। একেবারে দেশীয় উপাদানে পরিপূর্ণ এক মাতোয়ারা দিন।
তবে মধ্যরাতে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরুর একটি ঔপনিবেশিক মন এখনও সক্রিয় মনে হয়। প্রাচ্যের সময় গণনারীতি রজনীর মধ্যভাগে আরম্ভ হয় না। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই গেয়েছেন, “ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/আমরা আনিব রাঙা প্রভাত।” সেই রাঙা প্রভাতের অরুণরাঙা সূর্যই আমাদের জাতীয় পতাকায় শোভিত। সেটিই বাঙালির শ্রেষ্ঠ প্রতীক। পয়লা বৈশাখের ঊষালগ্নই আমাদের বর্ষ গণনার মাঙ্গলিক মুহূর্ত। সেটিই মঙ্গল শোভাযাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সত্য যেন আমরা বিস্মৃত না হই।
আমিরুল আলম খান, যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান