মহান বিজয় দিবস

মো. মোস্তফা মিয়া |

মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই উজ্জ্বল দিন, যেদিন এক দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের অবসান ঘটেছিলো আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো। অবশ্য তার আগের ৯ মাসে তারা হত্যা করেছিলো এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকে। আজ মহান বিজয় দিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি সেসব শহীদের আত্মদানের ইতিহাস। স্মরণ করছি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার ডাকে সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের আগে কিংবা পরে বাঙালির জীবনে এমন মুহূর্ত আর কখনো আসেনি, যখন সমগ্র জাতি এক অভিন্ন লক্ষ্যে এতোটা দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রধান কারণই ছিলো সেই লৌহদৃঢ় ঐক্য। যুদ্ধরত ঐক্যবদ্ধ বাঙালির লক্ষ্য ছিলো শুধু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করা নয়, শুধুই স্বাধীনতা অর্জনও নয়; চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে পাকিস্তানি শাসনামলের সব অন্যায়–অবিচারের চির অবসান ঘটবে; যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে; যেখানে জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার ভোগ করবে; যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, অর্থাৎ সব আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে।

এদিন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। তারপর গত প্রায় পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়; কমেছে শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।

তবে এসব অর্জনের বিপরীত দিকের চিত্র সুখকর নয়। এ সময় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ঘটেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে দুর্বল হয়েছে, ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা, প্রাণবন্ত জাতীয় সংসদ যেনো এক অপূরণীয় স্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতা, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব হয়েছে; এমন কিছু আইনকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে, যেগুলো একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের পক্ষে প্রতিকূল। মূলত রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দুর্বলতার কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর পরিণতিতে জনপ্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অনিয়ম, জবাবদিহির অভাব ক্রমেই প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়নি; ফলে খুন, ধর্ষণসহ নানা ধরনের গুরুতর অপরাধের প্রতিকার থেকে ভুক্তভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে; এক ধরনের বিচারহীনতার পরিবেশ অপরাধবৃত্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে। বিশেষত, নারীর প্রতি সহিংসতা গুরুতরভাবে বেড়েছে এবং বেড়ে চলেছে।

আর এক বছর পর আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্ণ হবে। একটি জাতির জীবনে অর্ধশত বছর নেহাত কম সময় নয়। যেসব স্বপ্ন–আকাঙ্ক্ষা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিলো; ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের পেছনে যেসব স্বপ্ন ছিলো; তার কতোটা আমরা পূরণ করতে পেরেছি, কতোটা পারিনি। যা পারিনি, তা কেনো পারিনি, এই আত্মজিজ্ঞাসা আজ অতি প্রয়োজন, প্রয়োজন এর উত্তর খুঁজে পাওয়া। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শপথ ও অঙ্গীকারের কথা আবারো স্মরণ করা দরকার। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে একাত্তরের মতো আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে প্রধান বাধা হলো রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার অভাব। যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হচ্ছে। ফলে সমাজে প্রতিহিংসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা থেকে রেহাই পাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক রাজনৈতিক সংলাপ। জাতীয় স্বার্থে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে সর্বজনীন উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।

বাংলাদেশকে একটি আদর্শ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করে তুলতে হলে বিজয় দিবসের তাৎপর্য আমাদের অবশ্যই যথার্থভাবে অনুধাবন করতে হবে। আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি অত্যাচারি শাসনের পরিবেশ বিরাজমান থাকা উচিত না।  টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানোই ৫২তম  মহান বিজয় দিবসে হোক আমাদের অঙ্গীকার।

বাংলাদেশের বাঙালি সমাজের সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা হলো বিগত বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অর্জন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে’ শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ  নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটানো। ইনশাআল্লাহ আমাদের পথ চলাকে কেউই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহান বিজয় দিবসের চেতনায় বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ গতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাক,  এই প্রত্যাশা করি।

লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি - dainik shiksha আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023379325866699