মহান যোদ্ধা হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃ*ত্যুবার্ষিকী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র হাজী শরীয়তুল্লাহর আজ মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের মধ্যে দিনে দিনে যে ধর্মীয় কুসংস্কার প্রবেশ করেছে তা উচ্ছেদ করে তাদের ইসলামের মূল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে । তিনি ওয়াহাবি আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রধান করণীয় কাজকে বলে ‘ফরজ’। এচিন্তা থেকেই তার সংস্কার আন্দোলনের নাম হয় ‘ফরায়েজি আন্দোলন’।

তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে শরীয়তুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি তার গুরু মওলানা বাশারত আলীর সঙ্গে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে গমন করেন, এবং ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন।

বাংলার মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছিলো ধর্মান্তরিত। তাই মুসলমান হওয়ার পরও স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে পূর্বধর্ম ও সংস্কৃতির অনেক কিছুর প্রভাব থেকেই যায়। এগুলো প্রকট হয়ে দেখা দেয় বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মক্কায় তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে তিনি সংকল্পবদ্ধ হন যে, দেশে ফিরে তিনি সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হবেন। তাই তিনি মক্কা থেকে দেশে ফিরে সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে তার নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিনি দুই রকম পাপ থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার কথা বলেন। প্রথমটি ‘শিরক’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘বেদাত’। এই লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের দুই দফা নির্দেশনা দেন-

(১) আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণ : এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা। কারণ সে সময়ের মুসলমান সমাজ প্রবর্তিত পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, শীতলা পূজা ইত্যাদি নানা ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দ্বারা গোটা বাংলার মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো বিদূরিত করে কুরআন ও সুন্নাহ মতে জীবন যাপনে উদ্ধুদ্ধ করা এবং ইসলামের ‘ফরজ’ কাজগুলো অবশ্যম্ভাবী পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানান। আর এই ‘ফরজ’ কথাটি থেকেই ফরায়েজি শব্দটি এসেছে।

(২) মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা: তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দূরবীক্ষণ দ্বারা অনুভব করেছিলেন যে, ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ছাড়া ভারতবর্ষের জনগণের মুক্তি অসম্ভব। আর এজন্য তিনি দরিদ্র কৃষক, তাঁতি শোষক শ্রেণিকে মহাজন, জমিদার, নীলকর, বণিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিলো আধুনিক ও মানবতাবদী। তৎকালীন সমাজের উৎপীড়নমূলক নিয়ম বদলে ভণ্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারণে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলো। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজি আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।

হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেননি। বরং তিনি চেয়ে ছিলেন ধর্মীয় জীবনে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে।

শরীয়তুল্লাহর নামানুসারে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল খাঁ নদের ওপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে হাজী শরীয়তউল্লাহ সেতু যা ৪৫০ মিটার দীর্ঘ। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ তার নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট বের করে। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস - dainik shiksha সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন - dainik shiksha এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত - dainik shiksha ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি উত্তপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাত ভাঙলেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব - dainik shiksha সাংবাদিক নিপীড়নের আইনগুলো এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দিতে আবেদন আহ্বান শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো - dainik shiksha শিরীন শারমিনের পদত্যাগে স্পিকার পদে কি শূন্যতা তৈরি হলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037150382995605