মহান শিক্ষা দিবসে স্মর্তব্য ও পরবর্তী কর্তব্য

মো. নজরুল ইসলাম, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর এলেই শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালি মাত্রই স্মরণ করে থাকেন ওয়াজিরউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ও বাবুল প্রমুখ শহীদদের। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচারী পাক-সামরিক শাসক গঠিত ও শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রণীত শিক্ষা-সংকোচন নীতির প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে পুলিশের বুলেটে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তারা। সাধারণ গণমানুষের শিক্ষার অধিকারকে পদদলিত করে স্বার্থান্বেষী ধনিক শ্রেণিকে প্রাধান্য দিয়ে তাদেরই স্বার্থকে সংরক্ষণ করার একটি হীন চক্রান্ত বাস্তবায়ন করার অপচেষ্টা চালান হয়েছিলো। ওই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে যে ইতিহাস অল্পবিস্তর সবারই জানা। সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসেরও আবর্তন ঘটে, পুনর্জন্ম লাভ করে চক্রান্তকারীরা এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। আর তাই স্বাধীনতা লাভের তেপান্ন বছর পরও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রতিনিয়তই নানা বিতর্ক উঠছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় অসংখ্য সমস্যা ও অসংগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং কর্মসূচির পরও আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে চলেছি। আলোচনা, সমালোচনা এবং দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে দেশ এখনো সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। উপরন্তু, যে শিক্ষা আমরা অর্জন করছি তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সনদসর্বস্ব শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার গুণগত মান এতোটাই নিম্নে যে আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পরও শুদ্ধ ভাষায় বাংলা লিখতে সক্ষম হচ্ছেন না। ইংরেজির কথা না হয় বাদই দিলাম। যেকোনো জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি অত্যন্ত নাজুক বিধায় পরবর্তীতে ওই ভিত্তির ওপর যা গড়ে উঠছে তা যে অত্যন্ত দুর্বল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিদ্যালয়সমূহে যথোপযুক্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। কারণ, শিক্ষকের বেতন প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল বলে এ পেশায় আসতে মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সিলেবাস/কারিকুলাম ত্রুটিযুক্ত, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত অবৈজ্ঞানিক অর্থাৎ সঠিক পরিবেশে পাঠদানের অনুকূল নয়-এ জাতীয় হাজারো সমস্যায় ঢিমেতালে এগিয়ে চলেছে আমাদের পাঠদান প্রক্রিয়া। 

শিক্ষা একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হলেও আমরা এখনো ঔপনিবেশিকতার সীমিত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি, পারিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং নোংরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে। সিলেবাস প্রণয়ণে আমাদের জাতীয় ইতিহাস যেমন উপেক্ষিত তেমনি বিশ্বমানের শিক্ষাদানের বিষয়টিও আমাদের সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির মগজে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রতিবছরই বাজেট তৈরিতে শিক্ষাখাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বিধায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে শিক্ষা বিষয়ে গবেষণার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যৌক্তিক কারণেই আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ভাষা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে। সামর্থ্যবান অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দেশে উপযুক্ত শিক্ষা লাভের পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায়। এতে করে আমরা হারাচ্ছি আমাদের মানবসম্পদ, দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে সার্বিক উন্নয়নে। আমাদের মেধাবী সন্তানরা ইউরোপ–আমেরিকায় গবেষণাকর্মে ব্যপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে অথচ আমরা দেশের কাজে তাদেরকে ব্যবহার করতে পারছি না, এর চেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?  

শিক্ষাব্যবস্থায় অগুনতি সমস্যার মধ্যে সাম্প্রতিককালের অন্যতম সমস্যা হলো ঘনঘন সিলেবাস পরিবর্তন। যে সিলেবাস তৈরি হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করবার জন্য পূর্বাহ্ণেই শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার ওপর কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য-আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রায় সবগুলো বৈশিষ্ট্যই অনুপস্থিত। আরো একটি উদ্বেগের বিষয় হলো নব্বইয়ের দশক থেকেই দেশের আনাচেকানাচে ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে না আছে পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস, না আছে যোগ্য শিক্ষক, উপরন্তু এখানে টিউশন ফি অন্যান্য খরচের ব্যাপকতা, সার্বিক অব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিক মানসিকতা জাতিকে রীতিমত উৎকণ্ঠিত করে।

সাধারণ অর্থে শিক্ষা হলো জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ বিচরণ। ইউরোপীয় রেনেসাঁ সর্বজনীন শিক্ষার ধারণাকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার অপরিহার্যতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। কিন্তু পুঁজিভিত্তিক অর্থনীতি সর্বজনীন শিক্ষার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশ এর ব্যতিক্রম নয়। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ একটি গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। দীর্ঘদিন ধরে আমরা পেয়ে আসছি শিক্ষানীতিবিহীন একটি দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ বিশেষ দিবসে অথবা টেলিভিশন টক শো তে মাঝে মাঝে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয় ঠিকই কিন্তু তা ওই আলোচনা পর্যায়েই সীমিত থাকে। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়াবার। বর্তমানে দেশ শাসিত হচ্ছে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক নয় বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং অতি দ্রুত কিছু সংস্কারে হাত দিয়েছেন। দেশের জনগণকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে তুলতে যে বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তা হলো-১. প্রাথমিক বা বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত শক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। ২. শিক্ষক নিয়োগের সময় দলীয় বিবেচনা বা অর্থের বিনিময়ে নয় বরং শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ৩. শিক্ষকের বেতন বাড়াতে হবে যাতে শিক্ষক আর্থিক চিন্তামুক্ত থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে শিক্ষাদানে নিয়োজিত করতে পারেন। ৪. শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়িয়ে শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে গবেষণাকর্ম চলমান রাখতে হবে। ৫. শিক্ষা খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে প্রয়োজনে বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে শিক্ষাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। ৬. নারীশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নারীশিক্ষাকে অবৈতনিক করে দিতে হবে। কারণ, নারী শিক্ষিত হলে তবেই জাতি শিক্ষিত হবে। ৭. শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির দুষ্টচক্রের বলয়মুক্ত রাখতে হবে।

আলোচিত বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ নজর দিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই ১৭ সেপ্টেম্বরের শহিদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা যেতে পারে এবং জাতিকে নিরক্ষরতামুক্ত করে একটি দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করে বাঙালি জাতিকে একটি উন্নত জাতিতে পরিণত করা যেতে পারে।

লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়      


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু - dainik shiksha পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত - dainik shiksha অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে - dainik shiksha প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত - dainik shiksha স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প - dainik shiksha নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি - dainik shiksha শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে - dainik shiksha গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063889026641846