চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় বই পেয়েছে। মায়ের ভাষায় শিক্ষার সুযোগে খুশি শিশু ও অভিভাবকরা। কিন্তু নিজেদের ভাষার পাঠ্য বই হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় তা পড়তে পারছে না শিশুরা। ফলে সরকারের মহতী উদ্যোগটি এখন থমকে আছে। ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত পাঠদানও।
পার্বত্য চুক্তি, জাতীয় শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও সনদে মায়ের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সেই তাগিদে বর্তমান সরকার প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পড়ালেখা শুরুর উদ্যোগ নেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি (বিঞ্চুপ্রিয়া ও মৈতৈ), তঞ্চঙ্গা, খাসিসহ দেশের অন্য সব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এদিকে দ্বিতীয় বছরের মতো মাতৃভাষার বই পেয়েছে শিশুরা। এবার থেকেই তাদের প্রথম শ্রেণির বইও দেওয়া হয়। বাংলা, ইংরেজি বইয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে মায়ের ভাষায় বই পায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। ফলে পাহাড়ের শিশুরা জড়তা কাটিয়ে বিদ্যালয়মুখী হবে বলে আশাবাদী ছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকায় সেই আশাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরী—এই পাঁচ ভাষার শিশুদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালাসংবলিত মাতৃভাষায় পাঠ্য বই প্রণয়ন করা হয়। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩৪ হাজার ৬৪২টি আমার বই ও ৩৪ হাজার ৬৪২টি অনুশীলন খাতা দেওয়া হয়। আর প্রথম শ্রেণির ৭৯ হাজার ৯৯২টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২৪টি জেলায় মোট এক লাখ ৪৯ হাজার ২৭৬টি বই ও পঠন-পাঠনসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো—বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রাজশাহী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, ফেনী, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৌসুমি ত্রিপুরা জানান, নিজ নিজ ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিতি না থাকায় শিক্ষকরাই সেসব বই পড়াতে পারছেন না। একই কথা বললেন একই স্কুলের শিক্ষিকা দিপা ত্রিপুরা। মারমা বর্ণমালা সম্পর্কে কিছুটা অবগত পানছড়ি পাইলট ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সানাই মারমা। তবে তিনিও শিক্ষকদের মাতৃভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
মারমা ভাষা কমিটির সদস্য ডা. অংক্যজাই মারমা জানান, প্রথম শ্রেণিতে ৭৫ শতাংশ মাতৃভাষা আর ২৫ শতাংশ বাংলা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ মাতৃভাষা আর ৫০ শতাংশ বাংলা এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ শতাংশ মাতৃভাষা আর ৭৫ শতাংশ বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসসিটিবি। কিন্তু এ বছর প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণিতে মাতৃভাষার বই দেওয়া হলেও শিশুদের পড়ানো হচ্ছে না বলে শোনা যাচ্ছে।
ত্রিপুরা ভাষা কমিটির সদস্য ও মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, তিন পার্বত্য জেলাতে বিদ্যমান তিনটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিটিআই) মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
অবশ্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিটিআই) চলতি ফেব্রুয়ারি থেকেই ভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী জানান, যুগান্তকারী সরকারি উদ্যোগটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মাতৃভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রাঙামাটির বনরূপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অর্চনা চাকমা জানিয়েছেন, প্রাক-প্রাথমিকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি বিদ্যালয়ে একজনমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দিয়ে চলছে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম। এতে মাতৃভাষা শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
এনসিটিবির চাকমা ভাষায় পাঠ্য বই লেখক প্রসন্ন কুমার চাকমা বলেছেন, মাতৃভাষার এই কার্যক্রম সফলের জন্য প্রথমেই শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
রাঙামাটি সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মফিজ উদ্দীন জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে তিন শতাধিক বিদ্যালয়ের ৭৬৩ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের জন্য একটি তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমাও জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাসেই পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণের পর আর সংকট থাকবে না।