মাধ্যমিকের ফল: ব্যর্থতা শিশুদের নয়, আমাদের

আমিরুল আলম খান |

মনুষ্যসমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নাকি অকারণে হুলুস্থুল। ইংরেজ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ার তো ‘মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং’ নামে আস্ত একখান নাটকই লিখে গেছেন এবং কমেডি হিসেবে সে নাটকের জনপ্রিয়তাও কম নয়। তামাম দুনিয়ায় সবচেয়ে উন্নত দেশ বলে দম্ভ করনেওয়ালা মার্কিনরাও অকারণ হুলুস্থুলে কম যায় না। তো, আমাদের মতো সবে উঠতি ধনী দেশে যে তেমনটি হবে না, সে আশা করা বাতুলতামাত্র।

এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ আছে। বাংলাদেশে সবকিছু নিয়ে হুলুস্থুল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কী নিয়ে কখন এবং কেন আমরা মাতামাতি করি, তা বুঝে ওঠা দায়। দেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল মাধ্যমিক। তার সে গৌরব গেছে। এখন পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষাই বড় পরীক্ষা। তা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ঘুম হারাম করেছে। বলা বাহুল্য, দেশের প্রায় ২৫ লাখ শিশু এক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রথম এই সমাপনী পরীক্ষার পুলসিরাত পার হতে চেষ্টা করে।

গতকাল এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হলো। এবার গড় পাসের হার গতবারের চেয়ে প্রায় ১০ ভাগ কমে হলো ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আমরা তার ব্যাখ্যা পেয়েছি দায়িত্ববান ব্যক্তিদের কাছ থেকে। শিক্ষামন্ত্রী সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। ভুল যাতে না করি, তাই পত্রিকা থেকে সে বয়ান তুলে দেওয়া ভালো। তিনি বলেছেন, ‘পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে আগে পরীক্ষকদের গাফিলতি আর ত্রুটি ছিল। এবার নতুন পদ্ধতিতে “যথাযথ” মূল্যায়ন হওয়ায় পাসের হার কিছুটা কমেছে।’ (সমকাল, ৭ মে, ২০১৮)। সেই ‘কিছুটা’ হলো প্রায় ১০ শতাংশ! সমকাল লিখেছে, ‘তিন বছর গবেষণা করে এবার নমুনা ও মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নে “সমরূপতা” এসেছে বলে দাবি আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের, যিনি বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটেরও (বিইডিইউ) প্রধান।’

হাসব, না কাঁদব? শিক্ষা বোর্ডে দীর্ঘ ২৩টি পরীক্ষা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বহুকাল থেকে শিক্ষা বোর্ডগুলো ‘নমুনা ও মানদণ্ড ঠিক করে’ সমরূপতা এনে থাকে। এতে অভিনবত্বের কিছুই নেই। কথাটি গত বছরও বলেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়; প্রতিবাদ করেছিলাম। এবার তার পুনরাবৃত্তি নিতান্তই হাস্যকর হলো।

এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে সারা দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল আকাশছোঁয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেই কবুল করা হয়েছে, মোট ১২টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, তাতে সর্বাধিক পাঁচ হাজার পরীক্ষার্থী সুবিধাভোগী হলেও বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। মানলাম, পাঁচ হাজারের জন্য ২০ লাখ শিক্ষার্থী কেন দুর্ভোগ পোহাবে? কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে বলে আসছিল, কারা সেই অপকর্মের ফসল গোলায় তুলেছে, তা তারা জানে। তবে এই পাঁচ হাজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া গেল না কেন?

দেশের মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয় না পাবলিক পরীক্ষার ফল জানার জন্য। প্রতীক্ষা উৎকণ্ঠা বাড়ায়; সে সমস্যার ঝাঁজ কত, তা মাপতে ছুটতে হবে চিকিৎসকের দরজায়। বেলা ১০টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফলাফলের অনুলিপি তুলে দিয়েছেন। আর বিকেল ২টা পর্যন্ত সে ফল পরীক্ষার্থী, অভিভাবক জানতে পারবে না, এই সামন্ত মানসিকতার অবসান কি নেই এ দেশে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে একটি অত্যন্ত দামি কথা বলেছেন। যারা কৃতকার্য হতে পারেনি, তিনি তাদের ওপর ‘বকাঝকা’ না করতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমি তাঁর এই আহ্বানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আমরা সবাই সফলদের নিয়ে মেতে থাকি। কিন্তু যারা অকৃতকার্য হয়, যারা কোনো কারণে এবার সফল হতে পারল না, তাদের মনোবেদনা বুঝতে চাই না। আমরা জানতে চেষ্টা করি না, কেন সে প্রত্যাশিত ফল করতে পারল না। আমরা কবুল করতে নারাজ যে এ ব্যর্থতা শিশুর নয়, এ ব্যর্থতা অভিভাবকের, গোটা সমাজের, রাষ্ট্রের। গতকাল শুধু যশোরেই মাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল না করতে পেরে অন্তত ১১ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছ। আমরা যেন তাদের প্রতি সদয় হই, সংবেদনশীল হই, তাদের পাশে দাঁড়াই, অভয় দিই। তাদের বলি, শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলই ভালোর মানদণ্ড নয়। জীবন অনেক বড়, সেখানে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। আমরা জানি, বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ‘গাধা’ বলে, আইনস্টাইনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণে ভালো ফল করেননি। দুনিয়ায় কোনো শিশুই ‘অপদার্থ’ নয়, সবার মধ্যেই প্রতিভা লুকিয়ে আছে। স্কুলের পরীক্ষা ভালো করেনি, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় অনেক ভালো করার সুযোগ তাদের আছে।

যারা পরীক্ষার সুতো পেরিয়ে ওপারে গেছে, তাদের মতোই যারা রয়ে গেল সুতোর এপারে, তাদের জন্যও আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও সহানুভূতি রইল। 

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023219585418701